সিলেটে তেলের সন্ধান : খনিতে তেল-গ্যাস সৃষ্টির কথকতা

সিলেট মিরর ডেস্ক


ডিসেম্বর ১২, ২০২৩
১২:৪১ অপরাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ১২, ২০২৩
১২:৪১ অপরাহ্ন



সিলেটে তেলের সন্ধান : খনিতে তেল-গ্যাস সৃষ্টির কথকতা


১০ ডিসেম্বর, ২০২৩। রোববার। একটি সুখবর ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশে। সিলেটের হরিপুর গ্যাসক্ষেত্রের ১০ নম্বর কূপ খননের প্রথম স্তরে তেল পাওয়া গিয়েছে।

বিষয়টি এখনও পরীক্ষামূলক। প্রতি ঘণ্টায় সেখান থেকে দিনে ৮০০ ব্যারেল তেলের প্রবাহ দেখা যায়। এছাড়াও একই কূপের তিনটি স্তরে নতুন গ্যাসের ক্ষেত্রও পাওয়া গিয়েছে। মাটির নিচে কী পরিমাণ তেলের মজুত রয়েছে সে তথ্য আরও সপ্তাহ পাঁচেক পর জানা যাবে।

 তেল, গ্যাসের মূল উপাদান হাইড্রোকার্বন। সহজে বললে, হাইড্রোজেন, কার্বন নিয়ে গঠিত যৌগকে হাইড্রোকার্বন বলে। এমন নয় যে এসব যৌগে অন্যকোনো উপাদান থাকে না। মূল উপাদানের পাশাপাশি অনান্য গৌণ উপাদান থাকে।

রান্নায় বা কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের মূল উপাদান মিথেন (CH4)। প্রাকৃতিক গ্যাসে এর পরিমাণ ৯৫ থেকে ৯৯ শতাংশ। এর গঠনে একটি কার্বন ও চারটি হাইড্রোজেন রয়েছে। অপ্রধান উপাদান হিসেবে থাকে প্যারাফিন হাইড্রোকার্বন— ইথেন, প্রোপেন, বিউটেন, পেন্টেন, হেক্সেন ইত্যাদি। প্রাকৃতিক গ্যাসের কোনও গন্ধ থাকে না।

নিরাপত্তার জন্য উপস্থিতি টের পাওয়ার জন্য গন্ধযুক্ত করা প্রয়োজন হয়। সে জন্য মিথেন গ্যাসে হাইড্রোজেন সালফাইড যোগ করা হয়। যার ফলে বিদ্ঘুটে গন্ধ টের পাওয়া যায়। অপরদিকে অপরিশোধিত খনিজ তেল বা পেট্রোলিয়ামে হাইড্রোজেনের পরিমাণ ১০ থেকে ১৪, কার্বন ৮৩ থেকে ৮৫ শতাংশ। এছাড়া নাইট্রোজেন, সালফার, অক্সিজেন থাকে।

অপরিশোধিত তেল ব্যবহার উপযোগী করার জন্য এর বিভিন্ন অংশকে আংশিক পাতন পদ্ধতিতে আলাদা করা হয়। দুই বা ততোধিক তরল পদার্থের মিশ্রণ থেকে উপাদানসমূহের স্ফুটনাঙ্ক অনুসারে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাতিত করে অংশ অংশ করে আলাদা করার প্রক্রিয়াকে আংশিক পাতন বলা হয়।


খনিতে তেল, গ্যাস কোথা থেকে আসে?

কিন্তু কৌতুলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে মাটির নিচে এসব তেল-গ্যাস কোত্থেকে জমা হয়! এ বিষয়টি ব্যাখ্যায় একটি শব্দ ঘুরে ফিরে আসবে। তা হলো ‘ফসিল ফুয়েল’ বাংলায় ‘জীবাশ্ম জ্বালানি’। জীবাশ্ম শব্দটিকে ভাঙালে ‘জীবের অংশ’ হয়। কোটি কোটি বছর বয়স এসব জীবাশ্মের। সে সময়কার উদ্ভিদ, প্রাণীর মৃতদেহ বা অবশেষ চাপা পড়ে মাটিতে। তল থেকে তলে তলিয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে। যত গভীরে পৌঁছায় ঠিক সে হারেই তাপ ও চাপ সৃষ্টি হয় সে স্থানে। অত্যাধিক তাপ ও চাপে জীবের অবশেষ জীবাশ্মে পরিণত হয়। 

কার্বন-ডেটিং-এর মাধ্যমে জানা যায়— এসব জীবাশ্মের বয়স ডাইনাসরদের হারিয়ে যাওয়ারও আগে। নির্দিষ্ট করে বললে ডাইনোসর নির্বংশ হয় ৬৫ মিলিয়ন বছর। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছরের আগের জীবাশ্মের ফল আজকের খনিতে পাওয়া তেল বা গ্যাস। 

জীবাশ্ম থেকে তৈরি হওয়া তেলের প্রাথমিক জৈব উপাদানের নাম কেলোজেন। সামুদ্রিক জীবের মৃতদেহ বা খণ্ডাংশ সমুদ্রের গভীর তলে জমা হয়। জীবের দেহে থাকা কার্বন ও জৈব উপাদান ধীরে ধীরে পলিমাটির তলে তলিয়ে যায়। দেহাবশেষ সময়ের সাথে পরিণত হয় শক্ত শিলায়। আমরা একে পাথর বলতে পারি। জমাট দেহের একেক স্থান থেকে একেক উপাদান পাওয়া যায়। দেহাবশেষের অক্সিজেনমুক্ত অবস্থা মোমের মতো পদার্থ তৈরি হয়। এ ধরনের পদার্থের নাম কেরোজেন। দুই থেকে তিন হাজার মিটার মাটির নিচের এই মোম উচ্চ তাপ ও উচ্চ চাপে তেল বা গ্যাসের রূপ পায়। ৯০-১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দুটো অবস্থাই থাকে। ১৬০-এর ওপরের তাপমাত্রায় মোম কেবল গ্যাস অবস্থায় থাকে।

আদতে এত নিচ থেকে মানুষের পক্ষে তেল বা গ্যাস সংগ্রহ কঠিন। প্রাকৃতিকভাবেই এসব স্তর কিছুটা ওপরে ওঠে আসে। সাধারণত ভূ-অভ্যন্তরের মহাদেশীয় প্লেটের কাঁপন বা ভূমিকম্পে তা হয়ে থাকে। 


বাংলাদেশের তেল-যুগের ইতিহাস

বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক গ্যাসের আধার বলা যায়। সে তুলনায় তেলের খনি নেই বললেই চলে। সিলেটের হরিপুর দুটো চাহিদাই মিটিয়েছে বাংলাদেশের। সেখানে ১৯৫৫ সালে প্রথম গ্যাসের খনি পাওয়া যায়। ঠিক ৩১ বছর পর সেই গ্যাসক্ষেত্রেই সিলেট-৭ কূপ খননের সময় মেলে তেলের সন্ধান। তারপরের বছর ১৯৮৭ সাল থেকেই উৎপাদন শুরু হয়। তখনকার তেল-স্তরটি প্রায় চার কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল। মাটির ২০২০ থেকে ২০৩৩ মিটার গভীরে বেলেপাথরের শিলাস্তরে। এই স্তরে মাটির পাঁচটি ভাগ রয়েছে। এরা বোকাবিল সংঘ নামে পরিচিত। স্যান্ড স্তর এ, বি, সি, ডি এবং ই। পাঁচ নম্বর ই-স্যান্ড স্তরেই তেল ছিল।

সিলেটের এই তেলক্ষেত্রের তেল গাঢ় বাদামি বর্ণের। যা প্যারাফিনিক বা আসক্তিহীন মোমযুক্ত তেল। এই তেলের ঘনত্ব মধ্যম মাত্রার এবং এপিআই গ্রাভিটির মান ২৮.২০ ডিগ্রি। দি অ্যামেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট গ্র্যাভিটি (এপিআই গ্র্যাভিটি) পেট্রোলিয়ামের মান নির্দেশক। পানির তুলনায় পেট্রোলিয়াম কতটুকু ভারী বা হালকা তা নির্দেশ করে এটি।

শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল এই স্তর থেকে ৬০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পাওয়া যাবে। কিন্তু এই স্তরে তেলের পরিমাণ এতই কম ছিল যে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত সাত বছরে প্রায় ০.৫৬ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন সম্ভব হয়। তারপর বন্ধ করে দেওয়া হয় তেল উত্তোলন।


নতুন আশায় হরিপুর তেলক্ষেত্র

রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ১০ নম্বর কূপের প্রথম স্তরে তেল পাওয়া গিয়েছে। প্রথম দিন ২ ঘণ্টায় ৭০ ব্যারেল তেলে উঠেছে। আশা করা যাচ্ছে আগামী ২০ বছর এই ক্ষেত্রের সুফল মিলবে। মাটির ১৩৯৭-১৪৪৫ মিটার গভীরতায় স্তরটির দেখা মেলে ৮ ডিসেম্বর। এই কূপে পাওয়া তেলের এপিআই গ্র্যাভিটি ২৯.৭ ডিগ্রি।


লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা কলেজ।


সূত্র: 

১. ইনভেস্টোপেডিয়া 

২. জাপান পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি লিমিটেড

৩. ব্রিটানিকা

৪. বাংলাপিডিয়া

সৌজন্যে: কালের কন্ঠ


এএফ/০৪