সময়সীমার ৩৯ দিন অতিবাহিত, ৮০ ভাগ বাঁধে শুরু হয়নি কাজ

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


জানুয়ারি ২৪, ২০২৪
১২:০৭ অপরাহ্ন


আপডেট : জানুয়ারি ২৪, ২০২৪
১২:০৭ অপরাহ্ন



সময়সীমার ৩৯ দিন অতিবাহিত, ৮০ ভাগ বাঁধে শুরু হয়নি কাজ
# হাওরপারে অসন্তোষ

হালির হাওরের ঘনিয়ার বিল সংলগ্ন ক্লোজার। উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা এ ক্লোজারের হাওরের ভেতরের অংশে সামান্য মাটি পড়েছে। নদী সংলগ্ন স্থানে এখনও মাটি পড়েনি। ছবি গত শুক্রবারের।


হাওরে বোরো রোপণ প্রায় শেষ। কৃষক এখন নিরাপদে ফসল ঘরে তোলার ক্ষণ গুনছেন। কিন্তু ফসলরক্ষা বাঁধের কাজের গতিপ্রকৃতি কৃষক সম্প্রদায়কে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলছে। বাঁধের কাজের নির্ধারিত সময়ের অর্ধেক সময় ইতোমধ্যে পার হয়েছে। তবে জামালগঞ্জের হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ কাজের অগ্রগতি ছিটেফোঁটা। এ নিয়ে হাওরপারে যেমন অস্বস্তি আছে, তেমনি পিআইসি গঠন থেকে শুরু করে কাজ এগিয়ে নেওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম, খামখেয়ালিপনা হাওরপারের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলছে। 

জানা যায়, এ বছর জামালগঞ্জের ৬টি হাওরে ৪২টি পিআইসির মাধ্যমে বাঁধের কাজ হওয়ার কথা। তবে কে কোথায় কীভাবে বাঁধের কাজ করবে তার অনুমোদিত পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনও প্রকাশ করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। যদিও জামালগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ফসলরক্ষা বাঁধ মেরামত কাজের জন্য ১৫টি পিআইসির তালিকা প্রকাশ করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বাকি পিআইসির তালিকা প্রকাশ না করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেকটা গোপনে ‘যা খুশি তাই’ করার নিয়ম বহির্ভুত কর্মকাণ্ডে গা ভাসিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের চোখ ফাঁকি দিয়ে অন্তরালে অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে বেড়ানোর নানা অভিযোগ আছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। যে কারণে বাঁধের কাজে সন্তোষজনক কোনো অগ্রগতি নেই। 

ইতোমধ্যে কাবিটা নীতিমালায় উল্লেখিত ৭৫ দিনের সয়মসীমার মধ্যে ৩৯ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়টি বাঁধে নামমাত্র মাটি পড়েছে। জামালগঞ্জের ৮০ ভাগ বাঁধে কাজ এখনও শুরু হয়নি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হবে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। গত শুক্রবার হাওর ঘুরে পরিস্থিতি খুব উদ্বেগজনক দেখা গেছে। 

হালি, শনি ও মহালিয়া হাওর ঘুরে দেখা যায়, মাত্র কয়েকটি বাঁধে নামমাত্র মাটি ফেলা হয়েছে। বদরপুর ও হাওড়িয়া আলীপুরের মাঝ অংশে ঘনিয়ার বিল সংলগ্ন ক্লোজারে সামান্য মাটি পড়েছে। এ ক্লোজারটি হালি হাওরের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হলেও কাজ চলছে খুব ঢিমেতালে। হাওরে যাওয়ার পথে দু’জনকে এ বাঁধে ভেকু দিয়ে মাটি ফেলতে দেখা গেলেও ফেরার পথে মেশিনসহ কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর বিপরীত পার শনির হাওরের বাঁধের চিত্র প্রায় একই। এ হাওরের মাত্র একটি বাঁধে মাটি ফেলতে দেখা গেছে। এ ছাড়া মদনাকান্দি ও আছানপুরের মধ্যস্থলের একটি বাঁধে মাটির কাজ সন্তোষজনক। তবে হালি হাওরের বাকি বাঁধের কোথাও মাটি ফেলার কাজ শুরু হয়নি। এমনকি হাওরের কোন জায়গায় কোথায় বাঁধ হবে তার কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। 

অপরদিকে, মদনাকান্দি গ্রামের বিপরীত পারে অবস্থিত মহালিয়া হাওরের কোনো স্পটেই কাজ শুরু হয়নি। এ হাওরে বড় দুটি ক্লোজার আছে। মদনাকান্দি গ্রামসংলগ্ন ক্লোজারটি খুবই ভয়ংকর। তবে সেখানে কাজ শুরুর কোনো আলামত চোখে পড়েনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে নির্ধারিত সময়ই শুধু নয়, বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ হবে কিনা, হলেও বাঁধ কতটুকু টেকসই হবে তা নিয়ে কৃষকের মধ্যে গভীর উৎকণ্ঠা আছে। এর বিপরীতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেকটা উদাসীন, দায়সারা রয়েছেন। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পিআইসি বলেন, ‘কাজ পাইছি। শুরুও করে দিয়েছি। আমার ৬০ ভাগ কাজ হয়ে গেছে। আশা করি আর কিছুদিনের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারব।’ তবে সরজমিনে তার বাঁধে গিয়ে কাজ শুরুর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে ওই পিআইসি বলেন, ‘টেকা দিয়া পিআইসি আনন লাগে এইডা আপনে জানেন, সবাই জানে। সবাই তো টেকা দিয়াই পিআইসি আনছে। আমিও আনছি। দেবাশীষ মেম্বার একাই তিনডা আনছে। যারা বেশি আনে তারা টেকা না দিয়া কি আনে?’

৭ নম্বর পিআইসির সভাপতি দেবাশীষ তালুকদার বলেন, ‘কাজ পাইছি। মহাইল্যার পশ্চিমে দিয়া বড় খাল যেডা এইডা। কাজ এখনও শুরু হইছে না। কাজ আর কয়দিন। পনরো দিনেই শেষ করন যাইব। আমার গাড়ি মধ্যনগর আছে। আইলেই কাজ শুরু কইরা দিমু। আর অখনও টেকাই পাইছি না, কাজ করমু কী।’

গত বৃহস্পতিবার পাগনা হাওর থেকে ফিরে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ও হাওর পারের কৃষক অঞ্জন পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, গত ১৫ ডিসেম্বর পাগনা হাওরের যে বাঁধে মাটি ফেলে কাজের উদ্বোধন করা হয়েছিল, সে বাঁধে সর্বসাকুল্যে ২০ ভাগ কাজ হয়েছে। এ ছাড়া এ হাওরের ১৩টি পিআইসির মধ্যে মাত্র একটি পিআইসিতে কাজ শুরু হয়েছে। বাকি কোনো পিআইসিতে কাজ শুরুর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। সবকিছু মিলে জামালগঞ্জে ৮০ ভাগ পিআইসিতে কাজ শুরু হয়নি। এখন পর্যন্ত বাঁধের কাজের যে অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে তাতে হাওর উচ্চ ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। এতে কৃষকসহ হাওর বাঁচাও আন্দোলন গভীর উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন তিনি। 

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও জানান, গণমাধ্যম ও সচেতন মহলের চোখ ফাঁকি দিতে এখন পর্যন্ত পিআইসির পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। সময়মতো গণশুনানি হয়নি। পিআইসি যাচাই বাছাইয়ের কোনো দিন-তারিখও হয়নি। কে কাকে কোন জায়গায়, কত বরাদ্দ দিয়ে পিআইসি দেওয়া হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। সবকিছু অন্দরমহলে সম্পন্ন করে কৃষকের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে যদি সব বাঁধে কাজ শুরু না হয় তাহলে হাওর বাঁচাও আন্দোলন কৃষক নিয়ে মাঠে নামবে। 

এ ব্যাপারে উপজেলা কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘সব বাঁধে কাজ শুরু হয়নি, এটা ভুল কথা। সব বাঁধেই কাজ শুরু হয়েছে। যেখানে শুরু হয়নি সেখানে মেশিন প্রস্তুত আছে। অচিরেই শুরু হবে। পিআইসি তালিকা প্রকাশের যে বিষয়টি সেটি আমি স্বাক্ষর করে আগেই দিয়ে দিয়েছি। যদি দেওয়া না হয়, তাহলে তালিকা দিতে বলব।’

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহি প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, ‘বাঁধের কাজ নির্বাচনী ব্যস্ততার জন্য কিছুটা পিছিয়েছে। তবে কাজ শুরু হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কাজের প্রগ্রেসিটা আমরা ভালো দিতে পারব। আশা করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারব। আর পিআইসি তালিকা আমরা এখনও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করিনি। সবগুলো পেলে দিয়ে দেব।’



এএফ/০১