নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৫
০৩:১৬ অপরাহ্ন
আপডেট : ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২৫
০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. এ এনামুল হক প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। সরকার হতভম্ব, পারছে নিয়ন্ত্রণ করতে?’ তিনি আরো বলেন, ‘বিচারে ড. ইউনুসের অনিহা নেই, আহতের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও নেই। কিন্তু চিকিৎসা হচ্ছে না। তারমানে সংস্কার কোথায় দরকার বুঝছেন? ’
আজ বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সিলেট নগরের কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে সিলেট প্রেসক্লাব আয়োজিত ‘সংস্কার, জাতীয় ঐক্য ও ভাবনা’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সিলেট প্রেসক্লাব সভাপতি ইকরামুল কবিরের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলামের পরিচালনায় নাগরিক সংলাপে প্রধান বক্তা ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক কামাল আহমদ চৌধুরী।
নাগরিক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শে^তপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. এ এনামুল হক বলেন, ‘এই সরকার এসেছে বেশি দিন হয়নি, ছয় মাস। এরই মধ্যে ১৫০-এর বেশি আন্দোলন হয়েছে। তারমানে সবাই সবারটা নিয়ে ব্যস্ত এবং সবাই ভাবছে-এই হচ্ছে একমাত্র সুযোগ। এমন চিন্তা থেকে এতসব আন্দোলন হচ্ছে। আন্দোলন কমছে না, বরং বাড়ছে। এই অবস্থায় ঐক্যমত তৈরির জন্য এ ধরণের সংলাপ।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘অধ্যাপক ড. ইউনুসের বিচারের প্রতি কোনো অনিহা আছে? নাই। আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে অনিহা আছে? নাই। কিন্তু তারপরও চিকিৎসা হচ্ছে না। তারমানে সংস্কারটা কোথায় করতে হবে বুঝতে পারছেন? শর্ষের ভেতরে ভূত।’
প্রত্যেক জায়গায় সংস্কার দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। সরকার হতভম্ব। পারছে নিয়ন্ত্রণ করতে? পারছে না? তারমানে আমাদের প্রত্যেকটা জায়গায় সংস্কার দরকার। কিন্তু এত সংস্কার এক সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আমাদের ঐক্যমত্য হওয়া উচিত নুন্যতম কিছু বিষয়ে, যে আমরা এই কয়টা বিষয়ে একমত এবং সেখানে আমরা একসঙ্গে কাজ করব। জাতি হিসেবে, দেশপ্রেমি হিসেবে।’
দেশাত্মবোধ, ন্যায়বোধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংস্কারের প্রথম শর্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেটা ছাত্ররা দেখিয়েছে। শুধু ছাত্ররা একা নয়, সবাই মিলে। যত লোক আন্দোলনে নিহত হয়েছে তাদের অধিকাংশ কিন্তু ছাত্র না। হিসাব অনুযায়ী অধিকাংশ সাধারণ লোক।’ কিন্তু তারা চিকিৎসা পায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ছাত্ররাই চিকিৎসাব্যবস্থা পায়নি, সুতরাং সাধারণ লোক পেয়েছে মনে করেন? অসম্ভব। এই পরিবর্তনগুলো আনা আমাদের দরকার।’ সবকিছুর জবাবহিদিতা থাকা দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এরকম ঘটনা ঘটলে যিনি দায়িত্বে থাকবেন, যিনি চিকিৎসক হয়ে চিকিৎসা দিতে রাজি হননি। আহত ছাত্র নিয়ে হাসপাতালে গেলে তার দায় ছিল না? কিন্তু কোনো চিকিৎসকের কী শাস্তি হয়েছে? হয়নি।’
সংস্কারের ক্ষেত্রে নূন্যতম বিষয়ে সবার একমত হওয়া দরকার জানিয়ে তিনি নেপালের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সবাই একমত হওয়া খুব কঠিন। যতগুলো বিষয়ে আমরা একমত হতে চাচ্ছি, ১১টা কমিশন, আমার কাছে মনে হচ্ছে এতগুলো বিষয়ে আমরা একমত হতে পারব না। যদি সবাই একমত হয়ে যেতে পারি তাহলে আমরা মানুষ থাকব না। মানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকবে, মানুষের মধ্যে সহনশীলতা থাকবে। মানুষ তখন মানুষ হবে যখন সে হিংস্রতা পরিহার করতে পারবে। সুতরাং এটা গুরুত্বপূর্ণ।’
শে^তপত্র কমিটিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি এমন কাউকে পাইনি যিনি বলেছেন দুর্নীতির জন্য আমি দায়ী। সবাই বলেছেন, উপরের কেউ দায়ী। কত উপরে বুঝতে পারছেন আপনারা? তখন আমি বললাম, আরেকটু বেশি উপরে উঠাইলে তো আল্লাহর কাছে চলে যাবে। অর্থাৎ কেউ স্বীকার করতে রাজি না, নূন্যতম সততা আমাদের মধ্যে নেই। শিক্ষক হিসেবে এ নিয়ে আমি দুঃখ পাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘কত রকমের দুর্নীতি আছে শুনলে অবাক হবেন। একসময় গল্পচ্ছলে বলতাম, ঘুষ টেবিলের নিচ দিয়ে দিতে হতো। গত ১৫ বছরে টেবিল সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তারমানে ঘুষ দিতে টেবিলের নিচ লাগে না।’ ঘুষ খাওয়ার জন্য আইন বদল করা হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আপনার ইলেকট্রিক মিটার আছে? ভালো মিটার বদলে দেওয়া হয়েছে যাতে করে আরেকজন সাপ্লাই করতে পারে। আমি কিছুদিন আগে একটা কমিটিতে আলোচনা করছিলাম, পল্লী বিদ্যুতের অসংখ্য মিটার এমনিতেই ঘুরে। তারা ডিজিটাল মিটার তৈরি করছে। সংযোগ না দেওয়া স্বত্ত্বেও মিটার ঘুরতে থাকে। বহু গ্রাহক এ নিয়ে আপত্তি করেছেন। আমার সঙ্গেও কথা হয়েছে। সিলেটেই হয়েছে। এখানকার প্রকৌশলীরাও আমাকে বললেন। আমি ঢাকায় গিয়ে যখন প্রকৌশলীদের বললাম সেকথা, তারা বললেন, স্যার ৩ শতাংশ তো নষ্ট হবেই। বুঝতে পারছেন? আমাদের গোড়ায় গলদ। আমরা মানুষ হচ্ছি না। আমরা সাধারণ ন্যায় অন্যায় বুঝতে পারছি না।’
ভালো জিনিস ফেলে বাদ কেনা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের বললাম, আমি কম্পিউটার কিনলে কি থ্রি পার্সেন্ট নষ্ট থাকে? ডিজিটাল আর কোনো জিনিস আমরা কিনি না। মানে পরিস্কারভাবে আপনার ভালো জিনিস ফেলে দিয়ে বাদ জিনিস কেনা হচ্ছে-বলা হচ্ছে এটা দরকার।’
দুর্নীতির উদাহরণ তুলে ধরে এসময় তিনি বলেন, ‘শুনলে অবাক হবেন, গত ২০১০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত শুধুমাত্র উন্নয়ন বাজেটে খরচ হয়েছে ১৭ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি? তাতে কত টাকার দুর্নীতি হয়েছে জানেন? প্রায় সাত লাখ কোটি টাকা, আমাদের হিসেবে। তারমানে এই টাকা কোথাও না কোথাও তছরুপ হয়েছে। এগুলো সব কী রাজনীতিবিদরা নিয়েছেন? জি¦ না? সরকারের আমলাদের ভাগ সবচেয়ে বেশি। আমরা যখন বলছি সংস্কার করব, এটাও সংস্কার করা উচিত।’
ভোট হলেই দেশ আগাবে এমন নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ভালো ভোট হলে তাতে দেশ এগিয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। ভালো ভোটের পরেও আগে দেশের অবস্থা খারাপ হয়েছে নানাভাবে। তারমানে আমাদের চিন্তা করতে হবে। আমি বলি সংস্কার করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তায়। স্বল্প মেয়াদি চিন্তা করে খুব একটা লাভ নেই কারণ স্বল্প মেয়াদে অনেক কিছু ঠিক করা যাবে না।’
আইন দিয়ে সবকিছু করা যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আইনের উর্ধ্বে মানুষ। বিচারককে মানুষ হিসেবে চিন্তা করা শিখতে হবে, শিক্ষক হিসেবে আমরাও মানুষ হিসেবে চিন্তা করব, আমরা যদি সবকিছু দলীভাবে, রাজনৈতিকভাবে নিই-তাহলে মানুষটা কোথায়। সবার উপরে মানুষ।’
এএফ/০৫