চা শ্রমিক দিবস : ৯৯ বছরেও মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

সজীব দেবরায়, কমলগঞ্জ


মে ২১, ২০২০
০৩:২২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ২১, ২০২০
০৩:২২ পূর্বাহ্ন



চা শ্রমিক দিবস : ৯৯ বছরেও মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

আজ ২০ মে ঐতিহাসিক চা শ্রমিক দিবস। ১৯২১ সালের এই দিনে ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক নিজেদের জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা চালান। এ সময় চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে বৃটিশ সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার চা শ্রমিককে হত্যা করে। এরপর থেকে প্রতিবছর ২০ মে চা শ্রমিকরা ‘চা শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন।

তবে বার বার দাবি জানানো এবং অনেক আন্দোলনের পরও গত ৯৯ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি দিবসটি। ঘুচেনি চা শ্রমিকদের বঞ্চনা।

আজ বুধবার (২০ মে) চা শ্রমিক দিবস পালন উপলক্ষে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মৃর্তিঙ্গা চা-বাগানসহ দেশের বিভিন্ন চা-বাগানের চা ছাত্র-যুব সংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে গুলিতে নিহত চা শ্রমিকদের স্মরণে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় দিনটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০ মে-কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

জানা যায়, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। ১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালিনীছড়া চা-বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় বৃহত্তর সিলেটে চা-বাগান তৈরির জন্য ভারতের আসাম, উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়। বিশাল পাহাড় পরিষ্কার করে চা-বাগান করতে গিয়ে হিংস্র পশুর কবলে পড়ে কত শ্রমিকের জীবন গেছে তার কোনো হিসেব নেই। এছাড়া ব্রিটিশদের অত্যাচার তো ছিলই।

তাদের অব্যাহত নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেও সরন ‘মুল্লুকে চল’ (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক সিলেট থেকে হেঁটে চাঁদপুরের মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছেন। তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে ব্রিটিশরা গুলি চালিয়ে শত শত চা শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। যারা পালিয়ে এসেছিলেন, তাদেরকেও আন্দোলন করার অপরাধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

মেঘনা ঘাটে আসাম রাইফেলস এর গোর্খা সৈনিকরা নির্মমভাবে চা শ্রমিকদের হত্যা করে। এরপর যারা বেঁচে ছিলেন, তারা নিরুপায় হয়ে আবারও বাগানে চলে আসেন।

কিন্তু দেশে এখনও চা শ্রমিকরা ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত। কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা-বাগানের শ্রমিকনেতা রবি মুন্ডা জানান, চা শ্রমিকদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এদেশে এনে স্বল্প মজুরীর মাধ্যমে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করানো হয়। তাই শ্রমিকরা নিজ মুল্লুকে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা সফল হননি। এখনও চা শ্রমিকরা বঞ্চিত রয়ে গেছেন।

চা শ্রমিকনেতা শংকর কৈরী জানান, এখনও চা শ্রমিকদের জীবনমানের কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা এখনও পূরণ হয়নি।

তিনি ২০ মে-কে রাষ্ট্রীয়ভাবে চা শ্রমিক দিবস ঘোষণা এবং ওই দিন সবেতনে ছুটি বাস্তবায়নের দাবি জানান। পাশাপাশি চা শ্রমিকদের চাকরি ক্ষেত্রে কোটারও দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রামভজন কৈরী বলেন, চা শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এসব বাস্তবায়ন না হওয়ায় তাদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

তার দাবি, অবহেলিত চা-শ্রমিকদের বাসস্থানের জায়গাটুকু তাদের নিজের নামে করে দিতে হবে। যাতে বাগান কর্তৃপক্ষ যখন-তখন ভূমি থেকে চা শ্রমিকদের উচ্ছেদ করতে না পারে। যে বসতভিটায় প্রায় দেড়শ বছর ধরে বসবাস করে আসছি, আমরা চাই সরকারের মাধ্যমে সেটা আমাদের নামে দেওয়া হোক। যদি সেটা করা হয়, তাহলে আমরা দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি পাব।

জাগরণ যুব ফোরামের সভাপতি মোহন রবিদাস বলেন, অত্যন্ত কষ্ট নিয়ে বলতে হচ্ছে এই মুল্লুকে চলো আন্দোলনের ৯৯ বছর পরেও চা শ্রমিকদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনও চা শ্রমিকরা চা-বাগান মালিক কর্তৃক অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। মাত্র ১০২ টাকা মজুরী (বি ক্লাস বাগান ১০০ টাকা আর সি ক্লাস ৯৯ টাকা) দিয়ে করোনাভাইরাসের মতো এই মহামারির মধ্যেও তারা (চা কোম্পানি) চা শ্রমিকদের দিয়ে ঠিকই দুইবেলা কাজ করিয়ে নিচ্ছে। এমনকি আজকের এই ঐতিহাসিক দিনেও কাজ করছেন চা শ্রমিকরা। কয়েকদিন পূর্বেও দু’মুঠো ভাতের জন্য কালিটি চা-বাগানের চা শ্রমিকদেরকে দীর্ঘ ১৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে 'ভুখা লং মার্চ' করতে হয়েছে। আজকের এই দিনেও দীর্ঘ আড়াই মাস ধরে রেশন-মজুরি না পেয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন রেমা চা-বাগানের চা শ্রমিকরা। এরকম প্রতিটি চা-বাগানের চা শ্রমিকরাই নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আজ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

 

এসডি/আরআর-০৫