এভাবে চলে যেতে হয় কামরান ভাই!

আহমেদ নূর


জুন ১৫, ২০২০
১২:৪৫ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ১৫, ২০২০
০২:৫০ অপরাহ্ন



এভাবে চলে যেতে হয় কামরান ভাই!

কামরান ভাই আর নেই-এটা ভাবতেই পারছি না। রাত ৩টা ৪৮ মিনিটে এক প্রিয় সহকর্মী যখন ফোন করে দুঃসংবাদটি দেয়-প্রথমে বিশ্বাস করিনি। সে জানায়, কামরান ভাইয়ের কাছের কয়েকজনও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মৃত্যু সংবাদ জানাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন রেখে মোবাইল ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকি। যুবলীগ নেতা মুশফিক জায়গীরদার, গোলাপগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র জাকারিয়া আহমদ পাপলুর স্ট্যাটাস চোখে পড়ে। ম্যাসেঞ্জারে দেখি আমেরিকা থেকে কল করেছে আরেক প্রিয়জন নিলেন্দু মাধব চক্রবর্তী। অনলাইনে না থাকায় তার কল মিস করেছি। একটু পরই তার ম্যাসেজ ‘সাবেক মেয়র কামরান সাহেব আর নেই, খবরটি কি সত্যি?’ আমি তার উত্তর দিতে পারি না।

জাকারিয়া পাপলুকে কল দেই। অনেকটা শাসানোর সুরেই প্রশ্ন করি, তুমি এমন স্ট্যাটাস দিয়েছ কেন? তুমি কি নিশ্চিত কামরান ভাই মারা গেছেন? সে অনেকটা থতমত খেয়ে বলল, ‘পরিচিত অনেকজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এমনকি কামরান ভাইয়ের ঘনিষ্টজনরাও।’ তবুও বিশ্বাস হতে চায় না। তাকে বলি তুমি কি কারও সঙ্গে কথা বলতে পেরেছ? ভাবি কিংবা কামরান ভাইয়ের ছেলে শিপলুর সঙ্গে? তার উত্তর না সূচক। তাকে বলি, নিশ্চিত হও, কারণ কয়েকদিন আগেও এমন গুজব ছড়িয়েছে অনেকে। ফোন কেটে দিয়ে আবারও ফেসবুকে চোখ রাখি। দেখি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলও ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এখন আর বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কিন্তু বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে। 

কামরান ভাইয়ের সঙ্গে আমার বয়সের তফাত থাকলেও তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের গভীরতা ছিল অননুমেয়। অনেক চন্দ্রভূক অমাবস্যা আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা সবকিছুই আমরা একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করেছি। একসঙ্গে কত বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি। এক সঙ্গে কারাবাসও করেছি। কারাগারের চার দেয়ালের ভেতর খোলা চত্বরে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছিও আমরা। আজ কামরান ভাই চলে গেলেন। এখন আমাকে, আমাদেরকে কাঁদতে হবে তাঁর জন্য। তাই তো, এই ভোররাতেও দেখি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাতজাগা মানষদের বুকফাটা কান্না। এ কান্না একজন নেতার জন্য, এ কান্না তাদের প্রিয় কামরান ভাইয়ের জন্য, এ কান্না একজন সদা হাস্যময় প্রাণখোলা মানুষ ব্যক্তি বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের জন্য। 

কামরান ভাই ছিলেন সিলেটের মাটি ও মানুষের নেতা। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। ছিলেন তৎকালীন পৌরসভার তিন তিন বারের নির্বাচিত কমিশনার। পরে পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং পরপর দুবার নির্বাচিত মেয়র। টানা ১৮ বছর নগর সংস্থার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন তিনি। ‘সিলেটের জননন্দিত মেয়র’ বাক্যটি যেন কামরান ভাইয়ের নামের অংশ হয়ে গিয়েছিল। এটি তিনি অর্জন করতে পেরেছিলেন। কামরান ভাইয়ের জন্য সিলেটের মানুষের বুকভরা ভালোবাসা সবসময়ই ছিল, আজও আছে। রাজনীতির বিচারে সেটি পরিমাপ করা সম্ভব নয়, করা ঠিকও নয়।

মহামারি করোনা আমাদের অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। আজ কেড়ে নিল কামরান ভাইকে। করোনাকালের শুরুতেই ফোন দিয়ে আমার এবং আমার পরিবারের সবার খোঁজ নিয়েছেন তিনি। ধারণা করি এমন অনেকেরই তিনি খোঁজ নিয়েছেন। কারণ এটাই তো তিনি সারাজীবন লালন করে এসেছেন। ভাবির করোনা শনাক্ত হওয়ার পর ফোন করে আবারও দোয়া চেয়েছেন। কিন্তু তিনি যখন করোনা আক্রান্ত হলেন তখন খবরটি শুনেই ফোন করে তাকে পাইনি। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে বিভিন্ন সূত্র থেকে তাঁর খবরাখবর পেতাম। গতকালও খবর পেয়েছি, তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন। নিজের হাতে খাবার খেয়েছেন। কিন্তু শেষরাতে এমন দুঃসংবাদ শুনতে হবে তা কখনও কল্পনাও করিনি। 

কিছুদিন আগে নিজে থেকেই ফোন দিয়েছিলেন। দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন সেদিন। অনেক স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছিলেন, ‘নূর ভাই, বিশ্বাস করেন-প্রায়ই মনে পড়ে আমাদের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।’ হ্যাঁ, কামরান ভাই, মনে পড়ে। আমাদের সোনালি দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। আর এখন থেকে আরও বেশি মনে পড়বে। কিন্তু মনে পড়ে আর কি হবে-আপনি তো চলে গেলেন। এমন তো কথা ছিল না। আমাদের তো পথচলা এখন শেষ হয়নি। এভাবে চলে যেতে হয়? এভাবে চলে গেলেন কামরান ভাই? এই বৈরী সময়ে?

কামরান ভাই ভালো গান গাইতেন। তাঁর কণ্ঠে অনেক গান শুনেছি। কোনো অনুষ্ঠানে আবার ঘরোয়া আড্ডায়। প্রয়াত সংগীত শিল্পী সুবীর নন্দীর অনেক জনপ্রিয় গান দরদ দিয়েই গাইতেন কামরান ভাই। প্রায়ই সুবীর নন্দীর এই গানটি তাঁর কণ্ঠে শুনতাম-‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম, তবু একটা কিছু হয়েছি যে তাতেই আমি ধন্য হলাম।’ কামরান ভাই, আপনি এই সিলেটের মানুষের কাছে সবসময় বন্ধুই ছিলেন। তাদের অন্তরে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছিলেন ব্যক্তি আপনি। তাদের অন্তর থেকে আপনাকে মুছে ফেলা যাবে না। ওপারেও ভালো থাকবেন, কামরান ভাই।