আমার অন্তিম সালাম মুহিত ভাই

শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদার


মে ০১, ২০২২
০৭:৫৪ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ০১, ২০২২
০৭:৫৪ অপরাহ্ন



আমার অন্তিম সালাম মুহিত ভাই

চলে গেলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাংলাদেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। এত বড় পদে থাকা মানুষেরা কেউই আমার পরিচিত বৃত্তের মানুষ হন না সাধারণত। কারণ অকিঞ্চিৎকর আমার এতটা উঁচুতে নাগাল পাওয়ার কোনো কারণ নেই। মানুষটা যেহেতু মুহিত ভাই, তাই এই ব্যতিক্রম। তবে যখন তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয় তখন তিনি মন্ত্রী বা পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন না। তখন তাঁর পরিচয় এক উন্নত মনস্ক মেধাবী বুদ্ধিজীবীর যার অন্তর প্রাকৃতিক থেকে মানবিক, সব পরিবেশ নিয়েই সংবেদনশীল। বোধহয় সেটা বছর কুড়ি আগেকার কথা। শিলচরে একদিন সকালে ফোন। অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বর বলল, আমার নাম আবুল মাল আবদুল মুহিত। আমি সিলেট থেকে বেড়াতে এসেছি এখানে। সিলেটের শুভেন্দু ইমাম আমাকে একটি তালিকা দিয়েছেন কার কার সাথে আমার দেখা হওয়া উচিত সেই বিবেচনায়। আপনার নামটি ওই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। তার মানে আপনি আমার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত জিজ্ঞেস করি, আপনি নিশ্চয়ই বেজুড়ার নন্দী মজুমদার? তার মানে কবি জয়নাথ নন্দী মজুমদারের বংশ? 

এভাবেই পরিচয়। মুহিত ভাই এসেছিলেন একেবারেই ব্যক্তিগত সফরে। সিলেট সীমান্তের এদিকটা তাঁর অপরিচিত অথচ এখানে প্রচুর সিলেটির বাস। পরিচিত হতে, হৃদয় বিনিময় করতেই এসেছিলেন। শুভেন্দু ইমামের দেওয়া তালিকার সূত্র ধরে জমে উঠল তাঁর প্রাত্যহিক আড্ডা এখানে ওখানে। এমনই একটি আড্ডায় তিনি একজন অভ্যাগতর সাথে ব্যক্তিগত মতবিনিময়ের সময় বৃহৎ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে তাঁর সাধারণ অমতের কথা বলেন। নিতান্তই পরিবেশ সচেতনতার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা সেই কথায় কোনো বিশেষ বাঁধ লক্ষ্যবস্তু ছিল না। তখনই আলাপ আলোচনায় এলো টিপাইমুখ বাঁধের প্রসঙ্গ। তিনি একই অমতের কথা বললেন একই ভাবে। অনানুষ্ঠানিক সেই আলোচনায় নিশ্চয়ই কান পেতে ছিল কোনো খোচর। পরের দিনই শিলচরের খবরের কাগজে প্রকাশিত হল সংবাদ, উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিয়ে অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশের এক অবাঞ্ছিত মানুষ এসে ভারত বিরোধী কথাবার্তা বলছে। চক্রান্ত করছে। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এই মানুষটি ভারত ত্যাগ না করলে তারাই সেই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেবে। সেই সময়ে মুহিত ভাই করিমগঞ্জে ছিলেন সুজিৎ চৌধুরীর সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যে। মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে কোনো ফোন নেই। যোগাযোগ করতে পারছি না। এই বর্বর হুমকির বিরুদ্ধে কিছু একটা করা উচিত এই নিয়ে যখন বন্ধু স্বজনদের সাথে বলছি, তখনই ই-মেল পেলাম মুহিত ভাইয়ের। লিখেছেন, কাল সকালে চলে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে এখানে থাকলে এখানকার অন্ধকারের শক্তি আরো সক্রিয় হবে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় আমার দেশের অন্ধকারের শক্তিও উৎসাহিত হয়ে তৎপরতা বাড়াবার সুযোগ নেবে। আমাদের কারো কাছেই কোনো দেশের অন্ধকারের শক্তির তৎপরতা বৃদ্ধি কাম্য নয়। তাই চলে যাচ্ছি। তুমি আমি আমরা যারা আলোর অভিমুখে চলি আমাদেরকে কখনো পিছিয়ে আসতে হয়। এটা পরাজয় নয়। ভবিষ্যৎ জয়কে সুনিশ্চিত করতেই এটা করতে হয়। আবার দেখা হবে আমাদের শিলচরে এবং সিলেটে। একটা সুন্দর ভবিষ্যতে। 

সময়টা তখনও ২০২২ নয়। ফলে শিলচরের একটি দৈনিকে মুহিত ভাইয়ের চলে যেতে বাধ্য হওয়া এবং সেই প্রসঙ্গে তাঁর ই-মেল নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখতে পেরেছিলাম। সময়টা ২০২২ ছিল না বলেই এই সময়ের হিন্দুত্বের উন্মাদ প্রবক্তা অতীন দাশও একটি অসাধারণ লেখা লিখেছিলেন এই বিষয়ে। পত্রিকার সংখ্যাগুলি পাঠিয়ে ছিলাম মুহিত ভাইকে। 

তারপর আর যোগাযোগ নেই। আমি শিলচর ছেড়ে বর্ধমানে চলে গেলাম। মুহিত ভাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়ে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন। বাংলাদেশে নিয়মিত গেলেও মুহিত ভাইয়ের সাথে দেখা করার চেষ্টা করি না। কারণ একটি সার্বভৌম দেশের অর্থমন্ত্রীর সাথে আমার কোনো কাজ থাকার কারণ নেই। আর অর্থমন্ত্রীরই বা আমার মত তুচ্ছ মানুষের সাথে কথা বলার মত সময় থাকবে কেন! ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম মাসে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর নববর্ষ শুভেচ্ছা এসে হাজির। আমি হতবাক। আমি বর্ধমানে চলে এসেছি এই খবরটাই শুধু মুহিত ভাই জানেন তা নয়, আমার ঠিকানাটিও সংগ্রহ করে নিয়েছেন। 

বর্ধমানে একবার বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল এলো অনুষ্ঠান করতে। অনুষ্ঠানের দিন মুহিত ভাইও থাকবেন শুনলাম। দেখা করতে গেলাম। তখনকার এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ব্যঙ্গ করে বললেন, এটায় একটা প্রটোকল আছে। যার তার সাথে দেখা করবেন না উনি। দর্শকাসনে দূরে বসে নির্লজ্জের মতই এগিয়ে গেলাম অতিথি আসনের দিকে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার চোখে তখন ভর্ৎসনার ইঙ্গিত। হঠাৎ আমাকে চোখে পড়তেই আসন ছেড়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে মুহিত ভাই। 'আমি ভাবছি বর্ধমানে এলাম, কিন্তু শুভ কি আসবে না?'

তারপরও একটু আধটু দেখা হয়ে গেছে বার তিনেক তাঁর সাথে আমার অন্য উপলক্ষ্যে। তিনি যতই আমার স্তরে নেমে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, আমার সাহস হয় নি তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার। ফলেই আরো অনেক বেশি করে তাঁকে পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হল না। 

চলে গেলেন মুহিত ভাই। তবে থেকে গেলেন হৃদয়ে আমার মত আরো অসংখ্য জনের। আমার অন্তিম সালাম নেবেন মুহিত ভাই।

শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদার- গণসংগীত শিল্পী, লেখক ও গীতিকার।

এএফ/০৫