শতবর্ষের অভিবাদন প্রিয় লিডার

আহমেদ নূর


জানুয়ারি ১৫, ২০২২
১২:১৫ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জানুয়ারি ১৫, ২০২২
১২:১৭ পূর্বাহ্ন



শতবর্ষের অভিবাদন প্রিয় লিডার

আব্দুস সামাদ আজাদ। রাজনীতির এক প্রবাদ পুরুষ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আপন মহিমায় উজ্জ্বল একটি নাম। ব্রিটিশ আমলে তাঁর ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পাকিস্তান আমলে তুখোড় রাজনীতিবিদ। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিন পতাকার অংশীদার এই মানুষটি তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞায় এক সময় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল পেরিয়ে উপমহাদেশের রাজনীতির এক মহিরুহে পরিণত হন। নিজের কর্মগুণে নেতা থেকে জননেতায় পরিণত হন। আজ ১৫ জানুয়ারি এই কীর্তিমান রাজনীতিকের জন্মশতবার্ষিকী।

এক মাস আগে আমরা উদযাপন করেছি বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। তার আগে গত মার্চে আমরা উদযাপন করি স্বাধীনতার ৫০ বছর। একই সঙ্গে আমরা উদযাপন করছি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। কিন্তু অতিমারি করোনার কারণে এই উৎসবগুলো আমরা যেভাবে উদযাপন করার কথা, তা করতে পারিনি। মুজিববর্ষ চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আবারও চোখ রাঙাচ্ছে করোনাভাইরাস। এরই মাঝে এসেছে জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদের জন্মশতবার্ষিকী।

আব্দুস সামাদ আজাদ ১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান জেলা) জগন্নাথপুর থানার চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়নের ভুরাখালী গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতির ময়দানে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভ‚মিকা অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামেও তাঁর অবদান নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল। এ ছাড়াও ছাত্র আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন এই রাজনীতিবিদ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর অনুপস্থিতিতে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।

আব্দুস সামাদ আজাদকে ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের শেষ এক দশক আমি তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলাম। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে খুব কাছে থেকে দেখেছি তাঁকে। যতই দেখেছি মুগ্ধ হয়েছি, সমৃদ্ধ হয়েছি। তাঁর মতো বিচক্ষণ, দূরদর্শী নেতা আমি খুবই কম দেখেছি। দলমত নির্বিশেষে সব সাংবাদিকের সঙ্গেই ছিল তাঁর সখ্যতা। একইভাবে সাংবাদিকরাও তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে কী-আমার পেশাগত জীবনে তাঁর মতো সাংবাদিকবান্ধব নেতা খুব কমই দেখেছি।

আব্দুস সামাদ আজাদ রাজনৈতিক কর্মী থেকে নেতা হয়েছিলেন। নেতা থেকে জননেতা হয়েছিলেন। সিলেটের অজপাড়া ভুরাখালী গ্রাম থেকে ওঠে এসে বিশ্বে ময়দানে রাজনীতি করেছেন। দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সর্বত্র। রাজনীতির মাঠে কিংবা কূটনৈতিক অঙ্গনে। বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতার সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সখ্যতা। এখানেই তিনি অনন্য ও অসাধারণ। যে কারণে তাঁকে বলা হতো ‘ভাটিবাংলার সিংহপুরুষ’। আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা।

জাতীয় রাজনীতিতে আব্দুস সামাদ আজাদের অবস্থান সবসময়ই সুদৃঢ় ছিল। সিলেটের রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান এবং সার্বিক তৎপরতা তারাই জানেন, যাদের দলের সবধরনের মেরুকরণ সম্পর্কে ধারণা ছিল। দলে এবং দলের বাইরে সামাদ আজাদের রাজনৈতিক ক‚টনীতির দক্ষতা পুরোপুরি বুঝতে হলে এসব বিষয়ে সম্যক ধারণা অবশ্যই থাকতে হবে। একটি বিষয় স্পষ্ট ছিল যে, সিলেট বিভাগে আওয়ামী লীগে বিভিন্ন সময়ে অভ্যন্তরীণ নানা মেরুকরণ হয়েছে। নানা গ্রুপও বিদ্যমান ছিল। বিভাগের চার জেলায়ই লীগ দুভাগে বিভক্ত থাকলেও একটি অংশের নেতৃত্ব সবসময়ই আব্দুস সামাদ আজাদের হাতে ছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই এটি চলে আসছিল। অন্য অংশের নেতৃত্ব সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়েছে। তবে এটাও ঠিক-অন্যদের বেলায় রাজনৈতিক অবস্থান নিজ জেলায় কিংবা পাশের জেলায় বিস্তৃত ছিল। কিন্তু সামাদ আজাদের নেতৃত্ব ছিল পুরো সিলেট বিভাগে। বিভাগের চার জেলায় ছিলেন সামাদ আজাদের অনুসারীরা। রাজনীতির এই মেরুকরণে আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গে পেরে উঠা খুব কষ্টকর ছিল অন্যদের জন্য। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তিনি যেমন পারদর্শী ছিলেন তেমনি রাজনৈতিক কূটনীতিতেও ছিলেন সফল। সেটা জাতীয় কিংবা স্থানীয় যে পর্যায়েই হোক।

আব্দুস সামাদ আজাদ প্রয়াত হয়েছেন আজ ১৭ বছর। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি পাড়ি জমান অনন্তলোকে। এরপর সুরমার জল অনেক গড়িয়েছে। দেশে ওয়ান-ইলেভেন সরকার এসেছে। বিরাজনীতিকরণের অপচেষ্টা হয়েছে। সেই গভীর সংকটের সময় একজন আব্দুস সামাদ আজাদের অভাব তিলে তিলে অনুভব করেছেন সবাই। ২০০৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। টানা তৃতীয়বারের মতো তাঁর দল ক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আব্দুস সামাদ আজাদকে নিয়ে খুব একটা চর্চা হয় না। জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীতে দায়সারা কর্মসূচি পালন করেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন সবাই। আজ এই নেতার জন্মশতবার্ষিকী। অথচ বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এমন কিছু এখনও জানতে পারিনি। তবে এটাও ঠিক-আব্দুস সামাদ আজাদের মৃত্যুর পর প্রথম দিকে কয়েক বছর প্রয়াত এই জননেতাকে স্মরণ করেছেন তার উত্তরসূরিরা। কিন্তু সেই ইফতেখার হোসেন শামীম, আ ন ম শফিকুল হক কিংবা বদরউদ্দিন আহমদ কামরান-তারাও যে আজ আমাদের মাঝে নেই।

চলতি বছর আব্দুস সামাদ আজাদের জন্মশতবার্ষিকী। আমি বিশ্বাস করি, তাঁর উত্তরসূরিরা তাঁকে মূল্যায়ন করবেন। নতুন প্রজন্ম যাতে তাঁর সম্পর্কে জানতে পারে, শিখতে পারে, তাঁকে ধারণ করতে পারে- সে উদ্যোগ অবশ্যই নেবেন। বছরব্যাপী নানা আয়োজন থাকতে পারে। আব্দুস সামাদ আজাদকে পূর্ণাঙ্গভাবে জানেন এবং মূল্যায়ন করতে পারেন, এমন গুণীজন এখন দেশে আছেন। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ।

আমি পেশাদার সংবাদকর্মী। নিজে একটি রাজনৈতিক দর্শন লালন করলেও পেশাগত কারণে কখনও সরাসরি রাজনীতি করিনি। কিন্তু আব্দুস সামাদ আজাদ আমাকে তাঁর স্নেহের বাঁধনে জড়িয়ে ফেলেন। আমার প্রতি তাঁর আস্থা, বিশ্বাস এবং গভীর আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হই। আমাকে এমনভাবে মুগ্ধ করেছিলেন যে-আমি তাঁকে ‘লিডার’ বলে সম্বোধন করতাম। আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার দিনগুলো আমার জীবনের এক বড় সঞ্চয়। তাঁর মতো নেতার সান্নিধ্য পাওয়া সৌভাগ্যের বলেও মনে করি। তিনি ছিলেন একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। তাঁকে ‘লিডার’ বলে সম্বোধন করতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করিনি। যদিও জীবনে আর কাউকে লিডার ডাকতে পারিনি কিংবা ডাকার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ভবিষ্যতে আর কবে তাঁর মতো নেতা এ দেশ কিংবা সিলেটবাসী পাবে, আমি জানি না! জীবনে আর কাউকে লিডার ডাকার সুযোগ পাব, এমনটিও মনে হয় না। শুধু আমার কথাই বলি কেন? যারা এখন রাজনীতির মাঠে টগবগে যুবক, তারা কি লিডার ডাকার মতো কাউকে খুঁজে পাবে? মনে হয় না। চোখ বন্ধ করে অন্তর্দৃষ্টি যতদূর নিয়ে যাওয়া যায়, তাতে এমন কারও অবয়ব দেখতে পাই না। সময়ের ব্যবধানে হয়ত অনেক পদবিধারী নেতা পাওয়া যাবে কিন্তু সত্যিকারের ‘লিডার’ পাওয়া যাবে কি? সেই রকম নেতার পায়ের আওয়াজ কই? কোথায় সেই মাটি ও মানুষের রাজনীতিক? আব্দুস সামাদ আজাদের মতো রাজনীতিকে নিয়ে ‘রাজনীতি-রাজনীতি’ খেলা খেলতে পারেন, এমন নেতা চোখে পড়ে কি? অন্তত আমার চোখে পড়ে না।

আমি বিশ্বাস করি-তাঁর জন্মই হয়েছিল রাজনীতির জন্য। আর তিনি শুধু রাজনীতিক ছিলেন না-তিনি ছিলেন এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তাই আজকে যারা রাজনীতি করছেন কিংবা আগামী দিনে যারা রাজনীতি করবেন তাদের জন্য আব্দুস সামাদ আজাদ অবশ্যই পাঠ্য বলে মনে করি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ঐকতান’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘কৃষাণের জীবনের শরীক যে জন,/কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,/যে আছে মাটির কাছাকাছি,/সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।’ আব্দুস সামাদ আজাদের মতো আরেকজন নেতা পাওয়ার জন্য সিলেটবাসী কিংবা দেশের মানুষকে কতকাল কান পেতে থাকতে হবে কে জানে!

শুভ জন্মশতবর্ষ লিডার।


----------------------------------------------

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক সিলেট মিরর