এমন সমাপ্তি চাইনি

আহমেদ নূর


এপ্রিল ৩০, ২০২২
০৫:১২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ৩০, ২০২২
০৫:২৩ পূর্বাহ্ন



এমন সমাপ্তি চাইনি

আমি স্তব্ধ, নির্বাক। এমন দুঃসংবাদ শোনার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। সন্ধ্যায় খবর পেয়েছিলাম তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু রাতে খবর পেলাম অবস্থার উন্নতি হয়েছে। রাত একটায় যখন খবর পেলাম তিনি আর নেই, তখন হৃদয়টা দুমড়ে-মোচড়ে উঠল। সাবেক অর্থমন্ত্রী, আলোকিত সিলেটের প্রবক্তা আবুল মাল আবদুল মুহিত আর নেই। ভাবতেও পারছি না। মেনেও নিতে পারছি না। যদিও তিনি পরিণত বয়সে মারা গেছেন, তবুও মনে হচ্ছিল আরও কিছুদিন আমরা তাঁর সান্নিধ্য পাব। আমার কষ্টটা আরও বেশি। এর সমীকরণ মেলানোও বেশ জটিল।

তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা গত ১৮ মার্চ। প্রায় দুবছর পর তিনি সিলেট এসেছিলেন। প্রথম দিনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কেন জানি মনে করেছিলেন আমি তাঁকে দেখতে যাইনি। তাই বারবার তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী কিশোর ভট্টাচার্য্য জনিকে বলছিলেন নূর কেন এলো না। তাই ১৮ মার্চ শুক্রবার দুপুর বেলা আবার তাঁর বাসায় যাই। আমাকে দেখেই তাঁর প্রশ্ন, তিনি এতদিন ধরে সিলেট আছেন আমি কেন তাঁকে দেখতে এলাম না। আমি বললাম, ‘স্যার, প্রথম দিনই আমি এসেছি।’ তিনি বললেন, ‘ও, তাই নাকি?’

সেদিন তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে। অনেক বিষয়ে জানতে চেয়েছি। কারণ তাঁকে নিয়ে সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তিনিও সম্মতি দিয়েছিলেন। করোনার কারণে গত দু-বছর সেটি এগিয়ে নেওয়া যায়নি। কিন্তু এবার যখন তিনি এলেন, তখন সবকিছু বিস্তারিত আলাপও সম্ভব ছিল না। তারপরও যা হয়েছে, তা কম ছিল না। বইটি এখন যন্ত্রস্থ। ঈদের পরেই তাঁর হাতে বইটি তুলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি তিনি দেখে যেতে পারলেন না। এর চেয়ে কষ্টের কী হতে পারে!

অসুস্থ অবস্থায় তিনি সিলেট আসার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু কে জানত এই আসা ছিল তাঁর সিলেটে শেষ আসা। তবে তৃপ্তির বিষয় যে, এই সফরে সিলেট সিটি করপোরেশন তাঁকে ‘গুণী শ্রেষ্ঠ সম্মাননা’ দিয়েছে। তিনিও সেদিন প্রাণখুলে কথা বলেছেন। যেন স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন। মৃত্যুর আগে এটাই এখন সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি শেষ সম্মাননা। এজন্য মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে আমার সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু ছিল, সেটা বুঝতে পেরেছি যখন শেষ দেখা হলো। বারবার তিনি আমার কথাই বলছিলেন জনিকে। আলাপচারিতার পর যখন উঠে আসব, তখন আমার হাতটি চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘আবার দেখা হবে নূর।’ আমি বলেছিলাম, ‘স্যার, এবার ঈদে সিলেট আসবেন তো?’ সেই চিরাচরিত ভঙ্গিকে বলেছিলেন, ‘ইয়েস, অফকোর্স। প্রতি বছর ঈদে এখানে ঈদগাহে নামাজ আদায় করে থাকি। কিন্তু গত দুটি বছর ঈদের জামাতেও আসতে পারিনি। এবার অবশ্যই আসব। সিলেটে ঈদের নামাজ পড়ব আশা করছি।’

ঈদের আর মাত্র দু-দিন বাকি। সিলেটে আর তাঁর আসা হলো না। ঈদের জামাতে অংশ না নেওয়ার অতৃপ্তিও তাঁর ঘুচল না। অথচ এই মানুষটিই আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে কোনো অতৃপ্তি নেই।’ ২০১৯ সালে আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কোনো অতৃপ্তি নেই। আমি ৫৬ বছর জনসেবা করেছি। জনসেবা করে যে আনন্দ পেয়েছি-তা বলার নয়। আরও কিছুদিন হয়ত বাঁচব। কিন্তু এই তৃপ্তিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। আমি এটাই বলতে চাই, অসীম তৃপ্তি নিয়েই আমি জীবনের সমাপ্তি ঘটাতে যাচ্ছি।’

স্যার, আপনি কতটা তৃপ্তি নিয়ে জীবনের সমাপ্তি ঘটালেন জানি না। তবে সত্যি বলছি স্যার, এমন সমাপ্তি আমরা চাইনি। এমন সমাপ্তি মেনে নিতে পারছি না। আমি তো কোনোভাবেই নয়। বইটা যে আপনার হাতে তুলে দিতে পারলাম না। অবশ্যই বইটি আমি বের করব। তবে তখন আপনি থাকবেন না। আমাকে ক্ষমা করবেন। ওপারে ভালো থাকবেন স্যার।

লেখক : সম্পাদক, সিলেট মিরর।