চালুর আগেই হাওরে বিলীন শাল্লার একমাত্র সড়ক

শামস শামীম, শাল্লা থেকে ফিরে


অক্টোবর ২৭, ২০২০
০৯:৫৫ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ২৭, ২০২০
০৯:৫৫ অপরাহ্ন



চালুর আগেই হাওরে বিলীন শাল্লার একমাত্র সড়ক
জলে গেছে সরকারের ৯১ কোটি টাকা

সরকারের পিছিয়েপড়া উপজেলা হিসেবে স্বীকৃত সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা শাল্লা। উপজেলাটির সঙ্গে জেলা সদরের সংযোগ স্থাপন করতে পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলা শহর থেকে সাড়ে ১৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি সড়ক ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১০ সালে। এটিই উপজেলার একমাত্র প্রধান পাকা সড়ক। ‘অসমাপ্ত প্রকল্প’ হিসেবে জনগুরুত্বপূর্ণ এ সড়কের কাজ ২০১৭ সালে শেষ হয়ে যায়। সড়কের সবগুলো সেতু-কালভার্ট নির্মাণ হলেও সড়ক নির্মাণ করা হয় মাত্র ৬০ ভাগ। তবে এর মধ্যেই জনগণ মোটরসাইকেলে করে সরাসরি দিরাই উপজেলা সদর হয়ে সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেই খুশি ছিলেন। কিন্তু গত তিন বছরের বন্যা ও চলতি বছরের প্রলয়ঙ্করী চারদফা বন্যায় নির্মিত সড়কের এক তৃতীয়াংশ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। প্রকল্পের অল্প কাজ শেষ করতে না পারায় ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষের স্থায়ী দুর্ভোগের পাশাপাশি সরকারেরও ৯১ কোটি টাকা জলে গেছে বলে মনে করেন উপজেলাবাসী। এখন সড়কটি সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করতে ৫৫৫ কোটি টাকার আরেকটি নতুন প্রকল্প তৈরি করে সড়ক বিভাগে পাঠিয়েছে সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগ।

সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলা শহরের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের জন্য শাল্লা উপজেলায় সাড়ে ১৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি সড়ক ২০১০ সালে নির্মাণ প্রকল্পে ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। দুইদিকে বিশাল হাওর থাকায় সড়কটি নির্মাণ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আবারও সময় বাড়ানো হয়। সড়ক বিভাগের মতে, একটি ‘অসমাপ্ত প্রকল্প’ হিসেবে এর কাজ বন্ধ হয়ে যায় ২০১৭ সালে। ১১০ কোটি টাকার প্রকল্পের মধ্যে সরকার ওই সময় পর্যন্ত ৯১ কোটি টাকা ছাড় করেছিল।

সড়কের অল্প কাজ বাকি থাকলেও ওই সময়ে মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে জনগণ সরাসরি শাল্লা উপজেলা সদর থেকে জেলা সদরে যাতায়াত করতে পারতেন। এতেই তারা খুশি ছিলেন। কিন্তু পর পর কয়েকটি বন্যায় নির্মিত সড়কটির এক তৃতীয়াংশ বা সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। চলতি বছরের চারদফা বন্যায় আরও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়কটি। বন্যায় ২টি কালভার্ট উল্টে অকেজো হয়ে গেছে। মাছুয়াখাড়া নামক স্থানে সড়কটির প্রায় ১২০ মিটার সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে হাওরে। তাই উপজেলাবাসীর একমাত্র সড়কটি দিয়ে যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। বর্ষায় নৌপথে যাতায়াত করলেও হেমন্তে হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছেন তারা।

সড়ক বিভাগের মতে, গত ৭ বছরে নকশা অনুযায়ী ১৯.৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ওই সড়কে ৪টি সেতু ও ১৫টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। ওই সময় পর্যন্ত সড়কের কাজ শেষ হয় ৬০ ভাগ। নির্মিত ওই ৬০ ভাগ রাস্তার মধ্যে ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় শাল্লা উপজেলার একমাত্র সড়কটি ‘মদনপুর, দিরাই, শাল্লা, জলসুখা, আজমিরিগঞ্জ’ সড়ক প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন করে সংস্কার-পুনঃনির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সড়ক বিভাগ। সড়কের প্রস্থ বৃদ্ধি, নিচু এলাকায় আরও ৩ ফুট উচ্চতা বৃদ্ধি, সাড়ে ১৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কের দুইদিকের পুরোটায় স্লোপ প্রোটেকশনও থাকবে। এই স্লোপ প্রোটেকশন না থাকলে বর্ষায় হাওরের উত্তাল ঢেউ থেকে রাস্তা টেকানো সম্ভব হবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া এই নতুন প্রকল্পে  বাংলাদেশ নদী গবেষনা ইনস্টিটিউট কর্তৃক হাইড্রোলজি ও মরফোলজি গবেষণা সুপারিশের আলোকে সড়কটি টেকানোর জন্য আরও একটি সেতু ও ৭টি কালভার্ট নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়াও ‘মদনপুর, দিরাই, শাল্লা, জলসুখা, আজমিরিগঞ্জ’ সড়ক প্রকল্পে কাঠইর, বোগলাখাড়া ও দরগাহপুরে ৩টি গার্ডার সেতু ও ৪টি বাজারে আরসিসি ইউড্রেন নির্মাণের কথাও বলা হয়েছে। এসব বিষয় নতুন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে সম্প্রতি ৫৫৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গতমাসে সড়ক বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে।

সরেজমিনে গত ১ অক্টোবর শাল্লা উপজেলার একমাত্র প্রধান পাকা সড়কটিতে গিয়ে দেখা যায়, শাল্লা ডিগ্রি কলেজের সামনের সেতুর পর থেকেই ভাঙনের শুরু। নোয়াগাঁও, আনন্দপুর, আঙ্গাউড়া, কাশিপুর, মাছুয়াখাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জনগণ এখন নৌকায় করে উপজেলা সদরে ও দিরাই উপজেলা সদরে এসে জেলা বা বিভাগীয় শহরে যাতায়াত করেন। আগে স্থানীয় জনতা পায়ে হেঁটে বা মোটরসাইকেলে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারলেও এখন সড়কটি স্থানে স্থানে বিলীন হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। সম্প্রতি সড়ক ও জনপথ বিভাগের সংশ্লিষ্টরাও বিধ্বস্ত সড়কটি দেখে এসেছেন। পানি কমে গেলেও এই সড়কটি আর ব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছেন তারা।

শাল্লা উপজেলার আঙ্গাউড়া গ্রামের বাসিন্দা দূরন্ত দাস বলেন, 'সরকারের পশ্চাদপদ হিসেবে তালিকাভুক্ত উপজেলা শাল্লা। এ উপজেলায় দিরাই উপজেলা সদর হয়ে আমাদের জন্য একটি সড়ক রয়েছে। এই সড়কটিরও নির্মাণকাজ ১০ বছরে শেষ হয়নি। তারপরও সড়কটি ব্যবহার করে আমরা মোটরসাইকেলে সরাসরি জেলা সদরে যোগাযোগ করতে পারতাম। সরকার শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে যে সড়কটি আমাদের করে দিয়েছিল, সেটির এক তৃতীয়াংশই বিলীন হয়ে গেছে।'

শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরী বলেন, 'আমাদের শাল্লা উপজেলার একমাত্র সড়কটির কাজ বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রচেষ্টায় শুরু হয়েছিল ১০ বছর আগে। কাজও প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। সরকার শত কোটি টাকা খরচ করে যে কাজ করেছিল, তা এখন হাওরের জলে বিলীন হয়ে গেছে। জলে গেছে সরকারের টাকা। আমাদের স্বপ্নের একমাত্র সড়কটি কয়েকদফা বন্যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চালুর আগেই সড়কটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় আবার কবে কাজ শুরু হবে আমরা জানি না।'

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, 'দিরাই-শাল্লা সাড়ে ১৯ কিলোমিটার সড়ক প্রকল্পটি ২০১৭ সালে অসমাপ্ত প্রকল্প হিসেবে শেষ হয়। গত তিন বছরের বন্যায় সড়কের প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। সেতু ও কালভার্টও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা নতুন করে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছি। প্রস্তাবটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে আমাদের কাছে পাঠালে আমরা চূড়ান্ত ডিপিপি করে পাঠাব।'

 

এসএস/আরআর-১২