আটকে আছে সাড়ে ৫ হাজার এমআরপি

নিজস্ব প্রতিবেদক


ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২১
০২:৪০ অপরাহ্ন


আপডেট : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২১
০২:৪১ অপরাহ্ন



আটকে আছে সাড়ে ৫ হাজার এমআরপি
# চরম ভোগান্তিতে আবেদনকারীরা # ই-পাসপোর্টের জন্য দীর্ঘ লাইন # এমআরপি আবেদন নেওয়া বন্ধ

সিলেটে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) আটকে আছে। পাঁচ মাসেরও অধিক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও পাসপোর্ট না পাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন আবেদনকারীরা। এদের মধ্যে অধিকাংশই বিদেশ গমনেচ্ছু।
যদিও সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, আটকে থাকা পাসপোর্টের সংখ্যা ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি নয়। প্রতিমাসে ৩শ থেকে ৪শ পাসপোর্ট সরবরাহ করা হচ্ছে বলে দাবি তাদের।

সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘পাসপোর্টগুলো ঢাকায় ছাপার অপেক্ষায় রয়েছে। আবেদনকারীদের ভোগান্তির বিষয়টি আমরা প্রধান কার্যালয়কে অবগত করেছি। প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি পাসপোর্ট প্রিন্ট হয়ে আসছে।’ মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ডেলিভারিতে দেরি হলেও ইলেকট্রনিক পাসপোর্টের (ই-পাসপোর্ট) আবেদন গ্রহণ ও কম সময়ে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদন জমা দিচ্ছেন শতশত নারী, পুরুষ ও শিশু। তখন সময় বেলা ৩টা। কয়েক ধাপ পেরিয়ে ছবি তোলা ও হাতের ছাপ দিতে তারা অপেক্ষা করছেন। আবেদনকারীরা জানিয়েছেন, সকাল ৯টায় পাসপোর্ট অফিসে গেছেন। প্রধান ফটকে প্রবেশ করেই প্রথমে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে হাতের ছাপ দিতে হচ্ছে (এটাকে আঞ্চলিকভাবে রোহিঙ্গা টেস্ট বলা হয়)। এরপর ১০৮ নম্বর কক্ষে তথ্য যাচাই ও ছবি তোলার কক্ষ নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। সেখানেও কখনও কখনও দীর্ঘ লাইন থাকে। এরপর ভবনের নিচতলা ও দুতলায় নির্ধারিত কক্ষে ছবি তোলা ও আঙ্গুলের ছাপ দেওয়ার পালা।

আবেদন জমা দেওয়ার পাশাপাশি পাসপোর্ট ডেলিভারি কক্ষেও রয়েছে ভিড়। কাক্সিক্ষত ক্ষুদে বার্তার প্রহর গুণে দীর্ঘদিন পর সেখানে ছুটে যাচ্ছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারস্ত হচ্ছেন। ভূক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এমআরপির আবেদন জমা দেওয়ার প্রায় ৫ মাস পেরিয়েছে। কারও কারও আবেদন করোনা পরিস্থিতির আগে জমা দেওয়া। এতদিনেও পাসপোর্ট না পাওয়ায় তাদের বিদেশযাত্রা অনিশ্চয়ত হয়ে গেছে। আবার অনেকে দালালদের মাধ্যমে অধিক টাকা পরিশোধ করে পাসপোর্ট পাচ্ছেন।

সিলেট পাসপোর্ট অফিসে নিজের পাসপোর্টের খোঁজ নিতে যান বালাগঞ্জের সাদ্দাম হোসেন। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘গত সেপ্টেম্বরে একটি ট্রাভেল এজেন্সির সহযোগিতায় এমআরপি পাসপোর্টের আবেদন করি। তখন ই-পাসপোর্টের বিষয়টি তেমন পরিচিতি পায়নি। জরুরিভিত্তিতে মাত্র ১০-১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসে তাকে ১২ হাজার টাকা দেই। কিন্তু এখনও পাসপোর্ট পাইনি।’ যদিও সাদ্দাম হোসেনের হাতে থাকা জমা স্লিপে পাসপোর্টের আবেদন ফি ৩ হাজার ৪৫০ টাকা লেখা ছিল।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে সুহাদা আক্তারের স্বজন মাছুম আহমদ বোনের পাসপোর্টের খোঁজ নিতে আসেন। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, বোনের স্বামী আরব আমিরাতে থাকেন। সুহাদা আক্তারও সেখানে যাবেন বলে মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট জমা দেন সিলেটে। কিন্তু, গত পাঁচ মাসেও তিনি পাসপোর্ট পাননি।

এদিকে, এমআরপির আবেদন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সিলেট পাসপোর্ট অফিস। তারা জানিয়েছে, আবেদনকারীদের ই-পাসপোর্ট আবেদনে উৎসাহ দিতে এবং যেহেতু কয়েক হাজার এমআরপির ডেলিভারি আটকে আছে তাই এই আবেদন (এমআরপি) নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

পাসপোর্ট অফিস আরও জানায়, সিলেটে গত পাঁচ মাসে অন্তত ১২ হাজার পাসপোর্টের আবেদন পড়েছেÑ যার সিংহভাগই ই-পাসপোর্ট। এর মধ্যে অন্তত ৫ হাজার ই-পাসপোর্ট সরবরাহ করা হয়েছে।

করোনা পরিস্থিতিতে মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সিলেট পাসপোর্ট অফিসে আবেদন জমা ও সরবরাহ বন্ধ ছিল। সেপ্টেম্বরে পাসপোর্ট অফিস খোলার পর ই-পাসপোর্ট আবেদন নেওয়া শুরু হয়। প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে তখন থেকেই পাসপোর্টের চাহিদা বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে ই-পাসপোর্টে মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না। কম সময়ে সরবরাহ ও আধুনিক সুবিধার বিষয়টি জানার পর ই-পাসপোর্টের দিকে ঝুঁক বাড়তে থাকে। তখন থেকেই চাপ বাড়তে থাকে।

এমআরপির আবেদন নেওয়া বন্ধ ও ই-পাসপোর্টে চাপ বাড়ার কারণে ই-পাসপোর্ট সরবরাহেও বিলম্ব হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত নভেম্বরে ১০ বছর মেয়াদের ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন সদর উপজেলা ইসলামপুরের যুবক রায়হান। তিনি বলেন, ‘কম সময়ে ই-পাসপোর্ট পাওয়া যাবে জেনে আবেদন করেছি। অথচ দেড় মাসেও পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়নি।’

এ বিষয়ে পাসপোর্ট অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি জানতে পেরেছেন আবেদনটির প্রাথমিক যাচাই হয়নি। ঢাকা থেকে যাচাই-বাছাই শেষে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য পাঠানো হবে। বিষয়টি সিলেট অফিসের আওতায় নেই বলে তিনি জানিয়েছেন।

পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, প্রথম দিকে ই-পাসপোর্ট দ্রুতসময়ে সরবরাহ সম্ভব হলেও ডিসেম্বর মাস থেকে আবেদনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় পাসপোর্ট ডেলিভারিতে বিলম্ব হচ্ছে। অপরদিকে, দালালের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে অনেকে দ্রুত পাসপোর্ট পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মামুন জানান, তিনি এমআরপির আবেদনের তিন মাস পর জানতে পারেন পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব হবে। এ খবরে তিনি বিদেশে ভিসা আবেদনের অনিশ্চয়তায় পড়েন। পরে দালালদের মাধ্যমে আরও চার হাজার টাকা খরচ করে এক সপ্তাহ পরেই তিনি পাসপোর্ট হাতে পান।

রূপম (ছদ্মনাম) নামের এক ব্যক্তি (যিনি পাসপোর্ট দালাল চক্রের সদস্য) জানিয়েছেন, ই-পাসপোর্ট চালু হওয়ার পর সিলেট পাসপোর্ট অফিসে তাদের প্রভাব কিছুটা হলেও কমেছে। তবে, অনলাইনে ফরম আবেদন এনরোলড (জমা দেওয়া) করার পর শিডিউল পাওয়া এবং হাতের ছাপ ও ছবি তোলার পর কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনুমোদন প্রক্রিয়ায় তাদের হাত এখনও শক্ত।

কেবল সিলেটে নয়; সারাদেশেই তাদের একটা নেটওয়ার্ক রয়েছে। যারা নিজে আবেদনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন তারা শিডিউল পেতে বিড়ম্বনায় পড়েন। অনেকে শিডিউল না পেয়ে বাধ্য হয়ে দালাল কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্ত হন। আবার যারা ট্রাভেলস ও দালালের মাধ্যমে জমা দেন তাদের ফাইল কম দিনে দ্রুত পাওয়ার ব্যবস্থা করেন পাসপোর্ট অফিসেরই কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারি।

তবে, পরিচালক একেএম মাজহারুল ইসলাম জানান, অফিসে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং দালালমুক্ত রাখতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন। গ্রাহক হয়রানি ঠেকাতে অফিসে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ কারণে গ্রাহকসেবা উন্নত হয়েছে। পাসপোর্ট অফিসের কেউ অতিরিক্ত টাকা দাবি করলে সরাসরি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

এসএইচ/আরসি-১৩