আব্দুল ওয়াছেহ চৌধুরী জুবের
মে ১৪, ২০২১
০৭:৩২ অপরাহ্ন
আপডেট : মে ১৪, ২০২১
০৭:৩২ অপরাহ্ন
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে এবারের ঈদ সমাগত অন্তত আমার কাছে। শিশু কাল থেকে অদ্যাবদি নানা রঙের ঈদ আমি পেয়েছি। যেখানে ঈদে আনন্দের পাশাপাশি বেদনা, আবার খুশির সঙ্গে অশ্রুকণাও ছিল সমানতালে।
শিশু কালের ঈদ নিয়ে তেমন কোনও স্মৃতি আজ আর মনে পড়ে না, মনে পড়ে ঈদের আগের রাতে আমার মা আর বোনেরা মিলে নানা পদের যে পিঠাগুলো বানাতেন, তা ওই রাতেই সবার আগে আমাকে খেতে দেওয়া হতো, হয়তো পরিবারের সবার ছোট বলে। আমিও দেদারসে খেতাম। ঈদের দিন সকাল বেলা নতুন কাপড় আর সেন্ডেল পড়ে পায়ে হেঁটে পাড়ার ছোট-বড় সবাই মিলে এক সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে শাহী ঈদগাহে হাজির হতাম।
প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময়ের এক ঈদের কথা আমি কখনও ভুলব না। আমরা দুই ভাই, যদিও বাবার কাছে সব আবদার ভাই আমাকে দিয়েই করাতেন। সম্ভবত আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। এক সন্ধ্যায় ভাই আমাকে তাড়া দিলেন বাবার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে আসতে। আমি বাবার সামনে উপস্থিত হলে, বাবায় বিষয় জানতে চান? তাঁর যখন মোড ভালো থাকত, তখনই ‘বিষয়’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। আমি বিষয়টি আঁচ করে সোজা তাঁর বুকের উপর উঠে বসে বলি, ‘টাকা দাও’। তিনি আবার বলেন ‘বিষয়?’। আমি তখন বেশ রাগ নিয়েই বলি বেশি ‘আ... করো না, টাকা দাও।’ বাবা ক্ষেপে গিয়ে ঠাস করে আমাকে চড় বসিয়ে দিলে আমি মাটিতে পড়ে যাই। আসলে এখানে না বলা শব্দটা ছিল চরম বেয়াদবি সুলভ। আমি তখন সেটা বুঝতাম না। ওই রাত আমার কাটে কান্নায়। পরদিন বাবা নিজ থেকেই আমার ভাইকে ডেকে নিয়ে পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দেন আমার ঈদ খরচ হিসেবে।
জীবনের সেরা ঈদগুলো কাটিয়েছি কৈশোরে। বিশেষ করে আমাদের এলাকায় শাপলা সংঘ নামে একটা ক্লাব ছিল। আমরা যারা ওই ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম, সবাই মিলে ঈদ এলেই পাড়ার সামনে ঈদ মোবারক লেখা গেট বানাতাম বাঁশ আর নাগেশ্বরের পাতা দিয়ে। কোনও কোনওবার আবার সেই গেটে লাগিয়ে দিতাম মরিচ লাইট। কত সুন্দরই-না লাগত! এ ছাড়া ঈদের দিন চুরি করে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখা ছিল আরেকটি নেশা।
নব্বই দশকের প্রথম দিকে বাবা হঠাৎ মারা গেলে ঈদের অনুভ‚তিই বদলে যায়। ঘাড়ে চাপে দায়িত্ববোধ। প্রচণ্ডভাবে অনুভব করি বাবা নামের কেউ একজনের উপস্থিতির গুরুত্ব। অনুভব করি আমার চাহিদা মেটাতে বাবার অক্ষমতার কারণ। আমি শুধু মাকে নিয়ে বাসায় থাকতাম। রমজানে মা প্রায় প্রতিদিন কাউকে না কাউকে ইফতার করাতেন। আমার কাছে টাকা থাকুক বা না থাকুক ঈদে উনার চাহিদা থাকতো গরিব কিছু মানুষের জন্যে।
১৯৯৬ সালের শেষ দিকে সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ঈদ সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে অনুভ‚ত হতে থাকে। ঈদের আগে দলীয় নেতা-কর্মী যারা কারাগারে থাকত অথবা যারা বাইরে অথচ ঈদের যে খুশি তা অনুভবই করতে পারত না, তাদের জন্যে কিছু একটা করার তাগিদ আমাদের সিনিয়রদের ছিল এবং ওই করতে পারার মধ্যে যে প্রশান্তি ছিল তা আজও অনুভব করি, তেমনি আজও বিরক্তি নিয়ে মনে করি ঈদের দিনের প্রটোকল ডিউটিকে। তবে এখনও খুব মিস করি ঈদের পরদিন এম. সাইফুর রহমানের বাগান বাড়িতে তাঁর আতিথিয়তাকে।
১৯৯৮ সালে বিয়ে করার পর ঈদ নেয় আরেক রঙ। দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। ১৯৯৯ সালে ভিন্ন মাত্রা পায় ঈদ। নিজে বাবার আসনে তখন। ইচ্ছে হয় ঈদে বাজারের যা কিছু সুন্দর, তা নিয়ে আসি আমার তুলতলে মা-মণির জন্যে। হ্যাঁ, অবশ্যই ১৯৯৯ সালের ওই ঈদ আমার কাছে এখন পর্যন্ত সেরা অনুভ‚তির, সেরা তৃপ্তির এক ঈদ। তবে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি সুখ আমার। গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির বিপরীতে থাকা অস্ত্র আর গোলাবারুদের রাজনীতির কারণে নিরাপত্তাহীন হয়ে ২০০০ সালেই দেশ ছাড়তে হয় আমাকে। কষ্টের, যন্ত্রণার, আবেগ অনুভ‚তিহীন কয়েকটা ঈদ কাটাই তখন ইউরোপে।
ঈদের দিন যদি শুক্র/শনিবার হয়, তো ছুটি হারাম হয়ে যায় রেস্টুরেন্ট কর্মীদের। এমনই এক শনিবারে যুক্তরাজ্যে ঈদ। আমি লন্ডন সিটিতে। সকালে পাশের এক মসজিদে ঈদের জামাত পড়ে বাসায় এসে নাস্তা করে রেডি হচ্ছি কর্মস্থল ব্রিস্টল যাবার জন্যে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আমি যখন বেরোব, তখন আমার পাঁচ বছরের শিশু কন্যাটি দৌড়ে এসে আমার কোলে উঠে বলে, ‘বাবা তুমি যেও না’। আমি তাকে আদর দিয়ে বুঝাতে গিয়ে বলি, ‘মা রে কাজে না গেলে খাবে কী?’ সে প্রায় জোর করে আমার কোল থেকে নেমে আবার একটি দৌড় দেয়। আমি দরজা খুলে গাড়িতে উঠব, তখন পেছন থেকে আমার মেয়েটি ডাকে। আমি তার কাছে যেতেই ওর মুষ্টিবদ্ধ হাত খুলে আমাকে চাল দেখিয়ে বলে, ‘বাবা তোমার যেতে হবে না, ফুফুর বাসায় ভাত আছে।’ আমি ওর কথার কোনও জবাব খুঁজে পেলাম না, আলতো করে ওকে একটি চুমু খেয়ে বলি, ‘ঠিক আছে মা আমি তোমার জন্যে মোরগ নিয়ে আসতেছি।’ বলেই গাড়িতে উঠে বসি। আমার অজান্তেই চোখ ভরে উঠে অশ্রæকণায়।
পুনরায় দেশে ফেরার পর হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনায় ঈদ ভালোই কাটছিল। আমার একমাত্র ছেলেও বড় হতে থাকে। তাই ঈদের দিনে প্রথম রুটিন হয়ে যায় ওকে নিয়ে সকালে শাহী ঈদগাহে ঈদের নামাজে যাওয়া। একবার এক ঈদের আগের দিন আমার শিশু পুত্রটি বলে, ‘আমাকে কাল দুই লাখ টাকা দিতে হবে।’ আমি হেসে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি এত টাকা দিয়ে কী করবে?’ সে বলে, ‘ঈদগাহে যাবার সময় গরিবদের দেব।’ পরদিন সকালে তার হতে দুই টাকার এক বান্ডিল নোট দিলে সে সেটাকেই দু-লাখ মেনে নিয়ে মনের আনন্দে ঈদগাহে যাওয়া-আসার পথে বিলিয়ে দেয়।
ঈদের সময় স্ত্রী-সন্তানদের পাশাপাশি আমার মাকে যখন নতুন কাপড় বা সেন্ডেল এনে দিতাম, তা দেখে তিনি যে নির্মল হাসি দিতেন এরচেয়ে বড় ঈদানন্দ আর কী হতে পারে? ২০১৯ সালে এমনি এক ঈদের রাতে মা আমাকে হঠাৎ ডেকে পাঠান। আমি সামনে গেলে তিনি তাঁর ওড়নার গিঁট খুলে আমার হাতে পাঁচশত টাকা একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে ঈদ করো।’ আমার চোখ দিয়ে অশ্রুকণা বের হবার আগেই টাকাটা তাঁর কাছ থেকে নিয়ে প্রায় দৌড়ে পালাই। ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখি-পাঁচশত টাকার ঈদ। অজস্র কমেন্ট আর হাজারও লাইকের মধ্যে আমার বড় বোনের কমেন্ট ‘তুই বড় ভাগ্যবান’ আমার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কাটে।
গত বছর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আমার মার ব্রেন স্ট্রোক করলে তাঁর বা পাশ পুরো অবশ হয়ে যায়। তিনি বাকশক্তি হারান। মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। লন্ডন আর আমেরিকা থেকে আমার দু-বোন মাকে দেখতে আসেন। মা সেটা বুঝতে পারেন না। করোনার কারণে আত্মীয়স্বজনও খুব একটা আসেন না। আমরাও বেরোতে পারি না। একদিন ঈদ আসে আবার চলেও যায়। বোনেরা ঈদের দিন মাকে অনেক চেষ্টা করেন ঈদের কথা বুঝাতে। কিন্তু সে পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব ছিল না। আজ আমার কাছে এটাই সান্তনা এরপরও তো মা ছিলেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর দুনিয়ার মায়া ছেড়ে মা চলে গেছেন। তাই আসন্ন ঈদ হচ্ছে এতিম হিসেবে আমার প্রথম ঈদ। তাই কোনও আনন্দ-উচ্ছাস নেই আমার মাঝে। মাকে ছাড়া প্রথম ঈদ কেমন হবে জানি না, তবে এটা নিশ্চিতভাবে জানি, খুব মিস করবো ‘মা’ তোমায়।