ক্রীড়া প্রতিবেদক
আগস্ট ০৪, ২০২১
০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন
আপডেট : আগস্ট ০৪, ২০২১
০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন
সমসাময়িক বড় অংশই জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করে ফেলেছেন অনেক আগে। কেউ কেউ স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। আবার অনেকে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে না পেরে দলের বাইরে। তার অনেক পরে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেটে আসা মোসাদ্দেক এখন বাংলাদেশ দলের গুরুত্বপূর্ণ অলরাউন্ডার। নিজে জাতীয় লিগে ভালো করছিলেন নিয়মিত। কিন্তু কোথায় যেন সুর কাটছিল বারবার। কাঞ্চনজঙ্গার মতো মেঘের আড়ালে বার বার ঢাকা পড়ছিল তার সাফল্য। তবুও তিনি থামেননি।
অসীম ধৈর্য আর দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে দেরিতে হলেও খুলল জাতীয় দলের কাঙ্খিত দরজা। সুযোগটা পেয়ে খুব বেশি সময় নেননি। বড় প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াকে সামনে পেয়ে রীতিমতো বাজিমাৎ করে দিলেন নাছুম। প্রতিপক্ষের ৪ উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচ সেরাও হলেন।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের কোনো জয় ছিল না। দীর্ঘদিনের এই আক্ষেপ সঙ্গে নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামেন মাহমুদুল্লারা। টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে স্বল্প রানের পুঁজি সংগ্রহের পর হারের চিন্তা মাথা থেকে সরানোর সুযোগ ছিল না। কারণ অস্ট্রেলিয়ার সামনে ১৩২ রানের লক্ষ্য কঠিন কিছু নয়। কিন্তু প্রথম ওভারে বল করতে এসে মেহদী উইকেট তুলে নেওয়ার পর দ্বিতীয় ওভারে এসে একটু খরচে ওভার করলেও ঠিকই উইকেট তুলে নেন নাছুম। সেই শুরু। এরপর একে একে অস্ট্রেলিয়ার চার উইকেট তুলে নিয়ে পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষের হার সময়ের ব্যাপার করে তুলেন এই স্পিনার। দেরিতে হলেও জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করতে এসে তিনি নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ যথাযথই কাজে লাগিয়েছেন।
নাছুম আহমদ সিলেটের ছেলে। সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলা ভাটিপাড়া মধুরাপুর গ্রামে ১৯৯৪ সালের ৫ ডিসেম্বর যার জন্ম। যদিও তাঁর বেড়ে উঠা সিলেট নগরের পীরমহল্লায়। সেখানে পাড়ার মাঠে খেলতে খেলতে এক সময় বন্ধুদের সঙ্গে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে যাওয়া। এক পর্যায়ে সিলেট জেলা দলের কোচ এএইচএম মাহমুদ ইমনের চোখে পড়া। কোচ ইমন প্রথম দিনই তাকে চিনতে ভুল করেননি।
এরপর এসেছে নানা সংকট, নানা প্রতিকূলতা। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ক্রিকেটকে ধরে থেকেছেন। অনুর্ধ্ব জেলা দলের হয়ে খেলতে খেলতে একসময় সিলেট জেলা ও পরবর্তীতে বিভাগীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু তার সমসাময়িক অনেকে জাতীয় দলে ঢুকে পড়লেও তিনি ডাক পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত প্রথম ডাক আসে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণে খেলার। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে এখন পর্যন্ত কেবল টি-টুয়েন্টিই খেলেছেন। অভিষেক হয়েছে এ বছরের মার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেডন পার্কে।
গতকাল মঙ্গলবার মিরপুর শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের পঞ্চম আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন নাসুম। আর সে ম্যাচেই নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন তিনি। বুঝিয়ে দিলেন বড় মঞ্চের জন্য নিজেকে জমিয়ে রেখেছেন তিনি।
নাসুম ২০১২ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে ছিলেন। যে দলের নেতৃত্বে ছিলেন আনামুল হক বিজয়। নুরুল হাসান সোহান ছিলেন বিজয়ের সহ-অধিনায়ক। এরা দুজনই অনেক আগে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন। অধিনায়ক বিজয় আশার ঝলক দেখালেও নিয়মিত পারফরমেন্স না করায় এখন দলের বাইরে। তবে সোহান নিজেকে উইকেটরক্ষক হিসেবে সেরা প্রমাণের পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। নাসুমের সহযোদ্ধা লিটন দাস ও সৌম্য সরকার এখন তো টাইগারদের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। তাসকিন আহমেদও পেসার হিসেবে নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন বেশ আগে। যে মোসাদ্দেকের বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে হারিয়ে প্রথম ট্রফি জয় করে বাংলাদেশ, সেই মোসাদ্দেকও এই দলের সদস্য ছিলেন। আবু হায়দার রনি ও নিজ বিভাগের আবু জায়েদ রাহি। যারা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে নিজেদের জাত চিনিয়েছেন বহু আগেই। কেবল নাসুমই ছিলেন নির্বাচকদের নজরের বাইরে।
অবশেষে জাতীয় দলের ১৫ জনের তালিকায় জায়গা করে নিলেন ততদিনে তার বসয় ২৫ বছর। তবে গত বছরের জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে স্কোয়াডে থাকলেও লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়ানো হয়নি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেডন পার্ক মাঠে সিরিজের প্রথম ম্যাচে একাদশে সুযোগ পেয়ে সম্ভাবনার আলো জ্বালিয়েছিলেন। ৩০ রান দিয়ে ৪ ওভারে শিকার করেছিলেন ফিন অ্যালেন ও মার্টিন অ্যালেনের মতো দুই সেরা ব্যাটসম্যানের উইকেট। যদিও পরের দুই ম্যাচে আর কোনো উইকেট পাননি তিনি।
সবশেষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষের সিরিজেও দলে ছিলেন নাসুম। প্রথম দুই ম্যাচে একাদশে জায়গা হয়নি। শেষ ম্যাচে সুযোগ হলেও ৩ ওভারে ৩৭ রান দিয়ে ছিলেন উইকেট শূন্য। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে তাই জায়গা হবে কিনা তা নিয়ে ছিল যথেষ্ট শঙ্কা। কিন্তু দল তার উপর ভরসা রাখে। নাসুমও এবার জয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে তার প্রতিদানও দিলেন। ৪ ওভারে ১৯ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে হয়েছেন ম্যাচ সেরা। তাতে যেন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন নাসুম।
জাতীয় দলে ডাক না পেলেও বরাবরই জাতীয় ক্রিকেট লিগে দৃষ্টি কেড়েছেন এই স্পিনার। জাতীয় ক্রিকেট লিগের ২০১৭-১৮ মৌসুমে রংপুরের বিপক্ষে এক ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। যেখানে প্রথম ইনিংসে উইকেট শিকার করেছিলেন ৯৭ রানে ৭টি। এরপর বিপিএল চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সে নিজেকে মেলে ধরেন নাসুম। বঙ্গবন্ধু টি-টুয়েন্টি লিগসহ নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে নাসুম অবশেষে জাতীয় দলে।
নাসুমের এই সাফল্যে ভীষণ খুশি সিলেটে তার কোচে এএইচএম মাহমুদ ইমন। তিনি বলেন, ‘নাছুমকে যখন প্রথমদিকে দেখি তখন আমার মনে হয়েছে সে অনেকদূর যাবে। যে কারণে সবসময় তার দিকে আলাদা চোখ রাখতাম। অনুশীলনে বিরতি দিলে খোঁজ নিতাম। তার পথ মসৃণ ছিল না। নানা সংকটের মধ্যেও সে ক্রিকেটটাকেই ভালোবেসে ছিল। দেরিতে হলেও সেই স্বীকৃতি সে পেয়েছে।’
আরসি-০৭