দুই শিশুকে তালাবদ্ধ রেখে চলে গেলেন শিক্ষকরা!

জামালগঞ্জ প্রতিনিধি


সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২১
০২:৪১ পূর্বাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২১
০২:৪১ পূর্বাহ্ন



দুই শিশুকে তালাবদ্ধ রেখে চলে গেলেন শিক্ষকরা!

এ যেন বিখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা’র মঞ্চায়ন। ওই চলচ্চিত্রে দেখা যায়, ছুটির ঘণ্টা বাজার পরপরই প্রকৃতির ডাকে বিদ্যালয়ের শৌচাগারে যায় ১২ বছরের শিশু শিক্ষার্থী খোকন। এর আগে ১১ দিনের ছুটি ঘোষণা হয় বিদ্যালয়ে। লম্বা ছুটি পেয়ে সব কক্ষে তালা লাগিয়ে দ্রুত বাড়ির পথ ধরেন দপ্তরী আব্বাস মিয়া। ততক্ষণে খোকন শৌচাগারে কাজ সেরে দরজা খুলতে গিয়ে দেখে দরজা বাইরে থেকে আটকানো। অনেক চেষ্টার পরও সে শৌচাগার থেকে বের হতে পারেনি। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ছুটির ১০ম দিনে শৌচাগারেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে খোকন।

গত বুধবার এমন অঘটন ঘটতে যাচ্ছিল সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের বেহেলী ইউনিয়নের তিলকই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তবে সেই অঘটনের ঘটক কোনো দপ্তরী নন, স্বয়ং শিক্ষক। স্কুলের পার্শ্ববর্তী বাড়ির বিকাশ বিশ্বাসের সাড়ে ৪ বছর বয়সী শিশুকন্যা জয়া বিশ্বাস ও নিধান চন্দ্র শীলের শিশুকন্যা শ্রাবন্তী শীলকে কক্ষের ভেতরে তালাবদ্ধ করে রেখে কর্মস্থল ত্যাগ করেন তিন সহকারী শিক্ষক। পরে তালাবদ্ধ শিশুর কান্না শুনে পার্শ্ববর্তী লোকজন তালা ভেঙে তাদেরকে উদ্ধার করেন। প্রায় আধা ঘণ্টা তালাবদ্ধ থাকা দুই শিশু ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন ঘটনাস্থলের সন্নিকটে যদি কোনো বাড়িঘর না থাকত, তাহলে বড় ধরনের অঘটন ঘটে যেতে পারত বলে জানিয়েছেন শিশুদের অভিভাবক ও স্থানীয়রা।

আজ রবিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তিলকই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের সহকারী শিক্ষক রিক্তা রায় একাই উপস্থিত আছেন বিদ্যালয়ে। সুনসান ছোট অফিসকক্ষে বসে তিনি একা লেখালেখিতে ব্যস্ত রয়েছেন। বিদ্যালয়টিতে ৪ জন শিক্ষক কর্মরত থাকলেও উপস্থিত আছেন কেবল রিক্তা রায়। প্রধান শিক্ষক মো. শুক্কুর আলী ঘটনার দিন এবং আজও স্কুলে উপস্থিত ছিলেন না। এমনকি স্কুলের পার্শ্ববর্তী বেহেলী গ্রামের দিলীপ পাল ও প্রাণতোষ পালও রবিবার স্কুলে যাননি। নিভৃত স্কুলে একজন শিক্ষিকার একাকী অবস্থান করাটা কতটুকু নিরাপদ তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন স্কুলের আশপাশের লোকজন।

এক প্রশ্নের জবাবে সহকারী শিক্ষক রিক্তা রায় বলেন, আজ কেউ স্কুলে আসেননি। কারণ সবাই বেতন তুলতে জামালগঞ্জে গেছেন। আর দুই শিশুকে কক্ষে রেখে তালা মারার বিষয়টিতে আমাদের ভুল হয়েছে। আসলে তালা মারার আগে আমাদের কক্ষগুলো দেখা উচিত ছিল।

ঘটনার দিন প্রধান শিক্ষক স্কুলে এসেছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রধান শিক্ষক সেদিন স্কুলে আসেননি। তিনি মিটিংয়ে ছিলেন।

শিশুদের অভিভাবকসহ স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, করোনার জন্য এমনিতেই স্কুল বন্ধ। যখন স্কুল খোলা ছিল, তখন কোনো শিক্ষকই নিয়মিত স্কুলে আসতেন না। আসলেও কেউ কেউ ছুটির অনেক আগেই চলে যেতেন। ইদানিং স্কুল খুলেছে অ্যাসাইনমেন্ট নেওয়ার জন্য। তাতেও শিক্ষকদের গাফিলতি রয়েছে। সদ্য স্কুল খোলার পর প্রধান শিক্ষক না কি একদিনও স্কুলে আসেননি। আর যারা এসেছেন তাদের দায়িত্ব কতটুকু আছে তা তারা সেদিন দুই শিশুকে কক্ষের ভেতরে রেখে তালা মেরে রেখে দেখিয়েছেন। আসলে তারা শুধু নামেই শিক্ষক।

অভিভাবক বিকাশ বিশ্বাস বলেন, তালা ভেঙে ঘর থেকে আমার মেয়েটাকে বের করার পর দেখেছি তার কী অবস্থা হয়েছে। আরও কিছুসময় ভেতরে থাকলে হয়তো সে ভয়েই মরে যেত। তার সঙ্গে আরেকটি শিশুও ছিল। দুই শিশুই ভয়ে কাঁদতে শুরু করে। তারপর আমরা এগিয়ে গিয়ে তাদের বের করে আনি। এ ঘটনায় শিক্ষকদের পুরো গাফিলতি ছিল।

তিলকই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শুক্কুর আলী বলেন, যেদিন ঘটনা ঘটেছে সেদিন আমি মাসিক সভায় ছিলাম। ভুলবশতঃ এ ঘটনাটি ঘটেছে। আমি থাকলে হয়তো ঘটনাটি ঘটত না। আর ঘটনার পর আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং বিষয়টি যে ভুল হয়েছে তা তাদেরকে বুঝিয়েছি। তারা মেনে নিয়েছেন।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, ঘটনাটি এইমাত্র শুনলাম। শিক্ষক-অভিভাবক কেউই আমাকে বিষয়টি অবহিত করেননি। যদি ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


বিআর/আরআর-১৫