উচ্চ রক্তচাপ: বিনামূল্যে মিলছে চিকিৎসা-ওষুধ

শুয়াইব হাসান


নভেম্বর ০৪, ২০২২
১২:২৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ০৪, ২০২২
১২:২৩ পূর্বাহ্ন



উচ্চ রক্তচাপ: বিনামূল্যে মিলছে চিকিৎসা-ওষুধ
আক্রান্তদের ৬০ শতাংশই পুরুষ // ২৫ সালে হৃদরোগে মৃত্যু ৭.৫ ভাগে নামানোর লক্ষ্য

দেশের বিভিন্ন উপজেলায় উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সেবা মিলছে। এমনকি, নিয়মিত রোগীরা কমিউনিটি ক্লিনিকে পাচ্ছেন ওষুধ।

সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার কোনাগ্রামের শামসুদ্দিন আহমদ (৬০) ছিলেন প্রবাসে। নিজের অজান্তেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। ধরা পড়ার পর দেশে ফিরে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন কয়েক বার। অনিয়মিত চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়া আর ওষুধ সেবনের কারণে তার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছিল না। এক বছর আগে যখন জানতে পারলে বাড়ির পাশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনামূল্যে সেবা পাওয়া যায় তখন থেকে তাকে আর ৬০ কিলোমিটার দূরের শহরে যেতে হয় না।
সম্প্রতি উপজেলার ছোটদেশ কমিউনিটি ক্লিনিকে কথা হয় শামসুদ্দিনের সঙ্গে। ওষুধ নিতে এসেছেন। শামসুদ্দিন জানান, আগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্ক্রিনিং করেছি। ওষুধ শেষ হয়ে হাসপাতালে গিয়ে আবার আনতে পারতাম। এখন বাড়ির পাশে কমিউনিটি ক্লিনিকে পাওয়া যায় তাই আর উপজেলায় যেতে হয় না।
শামসুদ্দিনের মতো কমিউনিটি ক্লিনিকে আরও অন্তত ১৫ জন নারী-পুরুষ ওষুধ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাদের মধ্যে, শেফা বেগম এসেছেন খাগরিপাড়া, শফিক উদ্দিন খান এসেছেন সুপাতলা থেকে। ক্লিনিকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৭ কিলোমিটার দূর থেকে অনেকে এসে সেবা নেন। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়।
২০১৮ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনসিডিসি) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ (এনএইচএফবি) যৌথভাবে সিলেটসহ দেশের ৫১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপিত এনডিসি (নন কমিউনিকেবল ডিজিজ-অসংক্রামক রোগ) কর্নার চালু করে।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এনএইচএসের (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস)-এর আদলে এসব কর্নারে চিকিৎসাসেবা প্রদানের পাশাপাশি অ্যাপসের মাধ্যমে রোগীদের ডাটাবেজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ১৫ হাজার ৩৫৬ জন রোগী নিবন্ধন করেছেন। চিকিৎসা নিয়ে ৬১ শতাংশ রোগীর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে, চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের বড় একটি অংশ নিয়মিত সেবা গ্রহণ করেন না। যে কারণে তাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. কামরুজ্জামান জানান, এনসিডি কর্নারে সেবা নেওয়া ৩১ শতাংশ রোগী অনিয়মিত। নিয়মিত সেবা নেওয়ায় ৪৭ শতাংশ রোগীর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ফেঞ্চুগঞ্চ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বালাগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও রাজনগর উপজেলার লোকজনও এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সেবা নেন বলে জানান তিনি।
সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে এ হাসপাতালে এনসিডি কর্নার চালু হয়। এরপর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৪ হাজার ৩৬৪ জন রোগীর ইউনিভার্সাল স্কিনিং করা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের রোগী ধরা পড়েছে ৬ হাজার ২৩১ জনের এবং ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে ১ হাজার ৩৮৬ জনের।
সম্প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, এনসিডি কর্নারের সামনে রোগীদের ভিড়। বয়স্ক নারী-পুরুষের পাশাপাশি মধ্য বয়সী মেয়েদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
সাবিনা বেগম (৩৪) এখান সেবা নেন ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল থেকে। বাড়ি উপজেলার পিটাইটিকর গ্রামে। তিন শিশুর জননী এই নারী উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভোগছেন। তিনি বলেন, ‘স্বামী মারা গেছেন। তিন সন্তান নিয়ে অর্থকষ্টে আছি। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। যখন শুনলাম এখানে বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়া যায় তখন থেকেই নিয়মিত আসি।’ তবে, মাঝে মধ্যে দামী কিছু ওষুধ মিলে না বলেও জানান এই নারী।
এসিডি কর্নারে দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফ নার্স জয়নুল আবেদিন জানান, প্রতিদিন নতুন-পুরাতন ২০০ জনকে সেবা দেওয়া হয়। এদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ ছাড়াও ডায়াবেটিস, কলেস্টোরেল ও হার্টের রোগী রয়েছেন। রোগীদের ৭ ধরনের নিয়মিত ওষুধ দেওয়া হয়।
তিনি আরও জানান, ‘সিম্পল অ্যাপস’-এর মাধ্যমে রোগীদের ডাটাবেজ সংরক্ষণের পাশাপাশি রোগীর সেবা বইয়ে বিপি স্টিকার (কিউআর কোড) লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিউআর কোড স্ক্যান করলে রোগীর যাবতীয় তথ্য পাওয়া যায়। তাদের ফলোআপ ট্রিটম্যান্টের জন্য এটি অত্যন্ত সহায়ক। প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ জন নতুন রোগী সেবা নিতে আসেন।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার দনারাম উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা (বিপিএড) শিক্ষক মো. আশরাফ আলী জানান, গত এক বছর থেকে তিনি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভুগছেন। ২০২১ সালের জুলাই মাসে তার প্রেসার ছিল ১৬০/১০০। এ বছর অক্টোবরের প্রথমার্ধ্বে তার বøাডপ্রেসার ছিল ১৪৪/৯৭।
তিনি আরও বলেন, ‘এনসিডি কর্নার থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসকদের তত্ত¡াবধানে সেবা ও ঔষধ গ্রহণ করে তার প্রেসারের কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। এখান থেকে তিনি প্রতিমাসে ৮ থেকে ৯শ টাকার ঔষধ বিনামূল্যে পাচ্ছেন।
হাসপাতালের এসিডি কর্নারে নিয়মিত রোগী দেখেন, মেডিকেল অফিসার ও সহকারী সার্জন ডা. উম্মে সালমা লিজা। উচ্চ রক্তচাপের আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি বলে জানান তিনি। অনুপাত পুরুষ ৬০ এবং নারী ৪০ শতাংশ।
ডা. লিজা বলেন, ‘খাদ্যাভ্যাস, জীবনাচরণ এবং সচেতনতার অভাবে গ্রামে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সচেতন হওয়ার পাশপাশি নিয়মিত ওষুধ সেবনে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে, রোগীরা সচেতন নয়। অন্য রোগের চিকিৎসা করতে এসে এটা ধরা পড়ে। অনেকে নিজেই জানে না তারা উচ্চ রক্তচাপে ভোগছেন।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে নানা রোগে যেসব মৃত্যু হয় তার ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগে। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
দেশে প্রতি পাঁচজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (২১ শতাংশ) উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই রোগে আক্রান্তের হার ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
এসব রোগীর সেবা নিশ্চিতে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক অলাভজনক সংস্থা রিজলভ টু সেভ লাইভসের সহযোগিতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডিসি এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন যৌথভাবে পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৮ সাল থেকে দেশের ৫৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনসিডি কর্নার চালু হয়। সদর উপজেলা ছাড়া বর্তমানে সিলেট বিভাগের ৩৬টি উপজেলায় এ কার্যক্রম চালু রয়েছে।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. এস এম শাহরিয়ার জানান, যুক্তরাজ্যের এনএইচএস-এর আদলে এনসিডি কর্নার থেকে সেবা পাচ্ছে রোগীরা। তাদের যাবতীয় তথ্য ন্যাশনাল ডাটাবেজে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কিউআর কোডযুক্ত বই নিয়ে রোগীরা দেশের যে কোন এনসিডি কর্নার থেকে সেবা ও ঔষধ নিতে পারছেন।

সেবা নিয়ে অনেক রোগীই সুস্থ হচ্ছেন জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, ‘রোগীর সুস্থতার হারও অনেক বেশি।’
এনএইচএফ-রিজলভ হাইপারটেনশন কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন-এর ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম জুবায়ের জানান, সদর উপজেলা ছাড়া সিলেট ও সুনামগঞ্জে ১১টি করে উপজেলা, মৌলভীবাজারে ৬টি, হবিগঞ্জে ৮টি, কিশোরগঞ্জে ১২টি ও জামালপুরের ৬টি উপজেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব উপজেলার এনসিডি কর্নারে গড়ে প্রতি মাসে নিবন্ধিত হচ্ছেন ৮৩৩২ জন রোগী নিবন্ধিত হচ্ছেন।
সিলেট বিভাগে এই পাইলট উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে এবং এটা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচআই) এর সহায়তায় গবেষণা ও আডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) মিডিয়া আডভোকেসির কাজ করছে।
জিএইচআই-এর কান্ট্রি লিড মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস জানান, এই প্রকল্পের পলিসি এডভোকেসির সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত রয়েছেন। রোগীদের অনেক সময় উপজেলা সদরে যাতায়াত ব্যয় সাপেক্ষ হওয়ায় কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে প্রকল্পটির বিস্তৃতি ঘটাতে তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করছেন।
এ বছরের মধ্যে তারা সারাদেশে দুইশ উপজেলায় এনসিডি কর্নার চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। আগামী বছর সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে এনসিডি কর্নার বিস্তৃত করা হবে। যেখানে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের সেবা দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. মাসুদ রেজা কবির জানান, ২০২৫ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে চানা তারা। এ সময়ের মধ্যে হƒদরোগজনিত মৃত্যুহার শতকরা ৭ দশমিক ৫ ভাগ এবং উচ্চ রক্তচাপের ব্যাপকতা শতকরা ২১ ভাগ থেকে ১৫ ভাগে কমিয়ে আনা প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে প্রটোকল মেনে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রদান ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। প্রকল্পটিকে অনুকরণযোগ্য মডেল হিসেবে দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করা গেলে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।