সুমুদ ফ্লোটিলার ‘আলমা’ নামের জাহাজে ইসরায়েলি আক্রমণ হয়েছে : শহিদুল আলম

নিজস্ব প্রতিবেদক


অক্টোবর ০২, ২০২৫
০৩:০৫ পূর্বাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ০২, ২০২৫
০৩:০৫ পূর্বাহ্ন



সুমুদ ফ্লোটিলার ‘আলমা’ নামের জাহাজে ইসরায়েলি আক্রমণ হয়েছে : শহিদুল আলম


ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখে যাত্রা করা নৌবহরে হস্তক্ষেপ শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নামের ওই নৌবহরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের কয়েকটি নৌযানে ইসরায়েলি সেনারা অবস্থান নিয়েছে। নৌযানগুলোয় থাকা ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গেছে।

বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানিয়েছে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। তাতে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলি সেনারা অবৈধভাবে নৌযানে হস্তক্ষেপ করছে। নৌযানগুলোয় থাকা সব অংশগ্রহণকারীর অবস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছি।’ ফ্লোটিলা বর্তমানে ভূমধ্যসাগরে গাজা থেকে ২১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে।


 ‘আলমা’ নামের জাহাজে ইসরায়েলি আক্রমণ হয়েছে

ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখী ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নামের নৌবহরের ‘আলমা’ নামের জাহাজে ইসরায়েলি আক্রমণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন এ যাত্রায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশের আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম। তিনি বলেন, আমরা ‘কনশানসসে’ আছি। এইমাত্র সংবাদ আসল, ‘আলমার’ ওপর আক্রমণ হয়েছে। এখন আমরা সবাই এখানে জড়ো হয়েছি। সবাই উদ্‌বিগ্ন। এখানে বসে বিভিন্ন জায়গা থেকে রিপোর্ট দিতে চেষ্টা করছি।

বুধবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা এক ভিডিও বার্তায় এসব কথা বলেন তিনি।

শহিদুল আলম জানান, আলমা একেবারে শুরুর দিকে ছিল, আমরা শেষের দিকে। কাজেই আলমার ওপর যা হচ্ছে, তা আমাদের ওপর হবে- এই অনুমান করা যায়। সে কারণে এটা আমাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

ফ্লোটিলার প্রধান নৌযান ‘কনশানস’। গত মঙ্গলবার ইতালির একটি বন্দর থেকে এটাতে ওঠেন শহিদুল আলম।


গাজার সাহায্য বহর আটকানোর ঘটনায় আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও বিক্ষোভ

আন্তর্জাতিক জলসীমায় গাজার উদ্দেশ্যে যাওয়া গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা আটক করার ঘটনায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনা, বিক্ষোভ ও আইনি বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। ফ্লোটিলার কর্মীরা নিরাপদে তাদের মিশন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ইসরায়েল অবৈধভাবে জাহাজে অভিযান চালিয়েছে।

ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের অভিযোগ: “এটা জলদস্যুতা ও অপহরণ”

ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েল গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা আটক করে যাত্রীদের অপহরণ করেছে। তারা বলেন, “বিবেকবান মানুষদের আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে অপহরণ করা হয়েছে। ফ্লোটিলা কোনো আইন ভঙ্গ করেনি। অবৈধ হলো ইসরায়েলের গণহত্যা, গাজার অবৈধ অবরোধ এবং ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।”

কোয়ালিশন এটিকে “জলদস্যুতা” এবং “অপহরণ” হিসেবে বর্ণনা করে, সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে লিখেছে,

“আপনার সরকারকে দাবি করুন যেন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে।”

জেরেমি করবিনের নিন্দা: “আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন”

যুক্তরাজ্যের সাবেক লেবার পার্টি নেতা ও স্বাধীন এমপি জেরেমি করবিন বলেছেন, ফ্লোটিলা আটকানো আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তিনি বলেন,

“এটি আমাদের সাধারণ মানবিক শালীনতার পরিপন্থী এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আরও অবমাননা।”

করবিন যুক্তরাজ্য সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, তারা জানত ফ্লোটিলা লক্ষ্যবস্তু হতে পারে, কিন্তু পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি আন্তর্জাতিক আইন রক্ষা, ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।


ইতালিতে বিক্ষোভ ও ধর্মঘট

ইতালির বিভিন্ন শহরে ফ্লোটিলা আটকানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। নেপলসে বিক্ষোভকারীরা প্রধান রেলস্টেশন অবরোধ করে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে, আর রোমের তেরমিনি রেলস্টেশন ঘিরে পুলিশ বসেছে।

ইতালির শ্রমিক ইউনিয়নগুলোও ধর্মঘট ডেকেছে। সিজিআইএল (CGIL) জানিয়েছে, “ইতালীয় নাগরিক বহনকারী বেসামরিক জাহাজে হামলা অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা।” উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেনোয়া শহরে ইউএসবি ইউনিয়ন বন্দরে বিক্ষোভ করার আহ্বান দিয়েছে।


আইনি বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ

আইনি বিশেষজ্ঞ ও আদালাহ কেন্দ্রের পরিচালক হাসান জাবারিন বলেছেন, “আইন অনুযায়ী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাদের দেশান্তর করা যায়, তবে গ্রেপ্তার করলে ৯৬ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। কিন্তু এবার ইসরায়েল কী করবে, তা জানা যায় না।”

তিনি বলেন, কিছু কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলেও সাধারণত দ্রুত মুক্তি দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার ও আদালতের প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর থাকবে। এছাড়া ইসরায়েলের ধর্মীয় উৎসব ইয়োম কিপুর আইনি প্রক্রিয়ায় বিলম্ব ঘটাতে পারে।


মার্কিন কর্মীর ভিডিও দাবি

ফ্লোটিলার মার্কিন নাগরিক লায়লা হেগাজি একটি আগেই ধারণ করা ভিডিও প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান,

“আমাকে ইসরায়েলি বাহিনী অপহরণ করেছে এবং আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে।”

তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, গাজার ফিলিস্তিনি জনগণের গণহত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ করতে এবং সকল মানবিক কর্মীর নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে।


ফ্লোটিলা কেন সাহায্য হস্তান্তর করবে না

ইসরায়েল ফ্লোটিলাকে জাহাজে থাকা সাহায্য সরবরাহ করতে বললেও ফ্লোটিলা কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের যুক্তি:

ইসরায়েল জাতিসংঘের পূর্ণ সহায়তা গাজায় প্রবেশ করতে দেয়নি, যা দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে এবং ক্ষুধাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে।

আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন বেসামরিক নাগরিককে ক্ষুধার দিকে ঠেলে দেওয়া নৌ অবরোধকে নিষিদ্ধ করে এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর নিরাপদ পথ নিশ্চিত করে।


গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা সমুদ্রপথে শুরুর কথা

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা সমুদ্রপথে গাজায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার একটি বৈশ্বিক প্রচেষ্টা। এই নৌবহরে রয়েছে ৪০টির বেশি বেসামরিক নৌযান। এই বহরে প্রায় ৪৪টি দেশের ৫০০ মানুষের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিক।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার প্রথম বহর ৩১ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৩ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর তিউনিসিয়া ও ইতালির সিসিলি দ্বীপ থেকে আরও নৌযান এই বহরে যুক্ত হয়। এ ছাড়া গ্রিসের সাইরাস দ্বীপ থেকে পরবর্তী সময়ে আরও কিছু নৌযান ত্রাণ নিয়ে বহরে যুক্ত হয়। সব মিলিয়ে বহরের নৌযানের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে যায়। তবে ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় বিকল হয়ে এবং যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পরে এ সংখ্যা ৪০–এ নেমে আসে।

এর আগে গত জুন মাসে গাজার দিকে ত্রাণ নিয়ে যাওয়া একটি নৌযান আটক করেন ইসরায়েলি সেনারা। গাজা থেকে প্রায় ১৮৫ কিলোমেটার দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ‘ম্যাডলিন’ নামে নৌযানটি আটক করা হয়। ওই নৌযানে গ্রেটা থুনবার্গসহ ১২ জন অধিকারকর্মী ছিলেন। পরে জুলাই মাসে নৌযান ‘হান্দালা’কে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। নৌযানটিতে ১০টি দেশের মোট ২১ জন ছিলেন। পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ইসরায়েলের এসব পদক্ষেপ সে সময় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।



এএফ/০১