সিলেটে শিশু-কিশোরদের কম্পিউটারবন্দী জীবন

নিজস্ব প্রতিবেদক


এপ্রিল ০৪, ২০২০
০৬:৪০ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ০৪, ২০২০
০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন



সিলেটে শিশু-কিশোরদের কম্পিউটারবন্দী জীবন

২০ জন স্কুল শিক্ষার্থীর সঙ্গে সিলেট মিরর-এর এ প্রতিবেদকের কথা হয়। করোনার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ১৪ জনেরই অবসর কাটে কম্পিউটার ও মুঠোফোনে গেমস খেলে। দুজন ছবি আঁকা ও গান চর্চার মাধ্যমে সময় কাটাচ্ছে। বাকি চার জন সময় কাটাচ্ছে বইপাঠে।

...

নাহিয়ান আহমদ। একটি বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বাসা পাঠানটুলা এলাকায়। গত আড়াই সপ্তাহ ধরে নাহিয়ান ঘরে বসেই সময় কাটাচ্ছে। অবসরে সে কম্পিউটার কিংবা বাবা-মায়ের মুঠোফোনে নানা ধরনের গেমস খেলতে ব্যস্ত থাকে। করোনোর কারণে বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার পর এ সময়টাতে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সে কোনো বই-ই পড়েনি। গেমস খেলেই সে সময় কাটাচ্ছে।

নাহিয়ান জানায়, করোনার ছুটিতে তার এখন অফুরন্ত অবসর। পড়াশোনার চাপও খুব বেশি নেই। তাই বেশির ভাগ সময়ই সে কম্পিউটার আর মুঠোফোনেই ব্যস্ত থাকে। আগে বিদ্যালয় চালুর সময় অযথা কম্পিউটার কিংবা মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত হলে বাবা-মা বকা দিতেন। এখন তাকে ঘরবন্দী করে রাখতে তাঁরা এতে বাধা দিচ্ছেন না। মোটামুটি ভালোই সময় কাটছে তার।

নাহিয়ানের চেয়ে একেবারেই ব্যতিক্রম খোদেজা বেগম। সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। বাসা বাগবাড়ি এলাকায়। খোদেজা জানিয়েছে, তার গল্প-উপন্যাস-বিজ্ঞানের বইপড়তে খুবই আগ্রহ রয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তাই এই অবসর সময়ে সে না-পড়া বইগুলো পড়ে নিচ্ছে। এরই মধ্যে সে তার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের একাধিক বই পড়ে ফেলেছে। বিজ্ঞান ও মহাকাশ-সম্পর্কিত দুটো বই পাঠও সে শেষ করেছে।

সিলেট নগরের ৮টি এলাকার ২০ জন স্কুল শিক্ষার্থীর সঙ্গে সিলেট মিরর-এর এ প্রতিবেদকের কথা হয়। এরা চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে প্রত্যেকেরই এখন অখণ্ড অবসর। তবে সকাল ও রাতে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তাদের মধ্যে ১৪ জনেরই সময় কাটে কম্পিউটার ও মুঠোফোনে গেমস খেলে। দুজন ছবি আঁকা ও গান চর্চার মাধ্যমে সময় কাটাচ্ছে। বাকি চারজন গল্প, উপন্যাস, কবিতা, বিজ্ঞানসহ নানা ধরনের বই পাঠের পাশাপাশি গান শোনা এবংগ্যারেজ ও ছাদে হালকা খেলাধূলা করে সময় অতিবাহিত করছে।

সেনপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোয়াজ্জেম হোসেন (৪৬) একজন বেসরকারি চাকুরিজীবী। তাঁর এক মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। তিনি সিলেট মিররকে জানান, মেয়ে যখন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত, তখন থেকেই তাকে তিনি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্যান্য বই পড়তে উৎসাহ দিতেন। পাশাপাশি গান গাইতেও তিনি উৎসাহ দিতেন। ছোটবেলা থেকেই এমন চর্চার কারণে তাঁর মেয়ে এখন নিয়মিতভাবে নানা ধরনের বইপড়ে থাকে। এখন করোনার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তাঁর মেয়ে বেশি করে বই পড়তে পারছে। তবে ছাদে গিয়ে বিকেল বেলা মেয়েকে হালকা শারীরিক কসরত করতেও বলছি। ছাদ-বাগান পরিচর্যার কাজে মেয়েকেও সম্পৃক্ত করছি।

বাগবাড়ি এলাকার বাসিন্দা সমরজিৎ দাশ জানান, তাঁর বারো বছরের ছেলে সারাক্ষণ মুঠোফোনে গেমস খেলা নিয়ে পড়ে থাকে। এই সময়টাতে তাকে ঘরে বন্দী রাখার জন্য তাঁরাও শাসন করতে পারছেন না। যে কোনো ছুঁতোয় ছেলেকে ঘরে রাখতেই তিনি মুঠোফোন ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। দুজন সচেতন অভিভাবক জানিয়েছেন, সন্তানদের শৈশবেই গড়ে নিতেহয়। এখনকার শিশু-কিশোররা মাঠে গিয়ে খেলার সময় পায় না। বিদ্যালয় শেষে কোচিং আর প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে দৌঁড়তে দৌঁড়তেই সময় চলে যায়। এর দায় সন্তানদের নয়, বরং অভিভাবকদের। কারণ, তাঁরা সন্তানদের আদর্শ মানুষ হিসেবে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠতে সহায়তা করেন না। কেবল পাঠ্যপুস্তক-নির্ভরই সন্তানদের গড়ে তুলতে তাঁরা আগ্রহী। করোনার এই বন্ধে সন্তানদের পাঠাভ্যাস বাড়াতে অভিভাবকেরা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

ঝরনারপাড় এলাকার শিব্বির হোসেন নামের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্র বলে, ‘আমি সকালে ঘুম থাকি উঠি পড়ি। সন্ধ্যার পর আবার পড়ি।’ অবসর কীভাবে কাটাও-এ প্রশ্নের জবাবে সে বলে, ‘বাবার মোবাইলে গেম খেলি।’ওই শিক্ষার্থীর বাবা মাহমুদুল হোসেন বলেন, ‘আসলে ছোটবেলা থেকেই তার (শিব্বির) মোবাইলে গেম খেলাটা অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন এই আসক্তিও দূর করতে পারছি না। এখন করোনার কারণে ঘরবন্দী হওয়ায় পড়াশোনার চাপ অনেকটাই কমে গেছে। তবে তার মোবাইলে গেম খেলার পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। বাচ্চাকে ঘরে রাখার জন্য এতে বাধাও দিতে পারছিনা। যদিও জানি, এমনটা করা আমার উচিত হচ্ছে না।’