ঘরে নেই খাবার, তবু আটকে থাকেনি মানবসেবা

সাইফুল্লাহ হাসান, মৌলভীবাজার


এপ্রিল ১৬, ২০২০
১২:৪৪ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ১৬, ২০২০
১২:৪৪ পূর্বাহ্ন



ঘরে নেই খাবার, তবু আটকে থাকেনি মানবসেবা

মনা মিয়া। একজন খেটে খাওয়া মানুষ। মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে তার আয়-রোজগার সব এখন বন্ধ। এর পরও তিনি না খেয়ে, কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়া এই সংকটময় মুহূর্তে মানবসেবা করে যাচ্ছেন। সকাল ৮টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত টানা ১৭ ঘন্টা তিনি রাস্তায় থাকেন। সেই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী প্রতিটি গাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটিয়ে দেন।

মনা মিয়ার বাড়ি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন ফুলতলায়। তিনি মৃত সুফি মিয়ার ছেলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাইরাস প্রতিরোধ করতে বিশ্বের অনেক দেশ লকডাউন করা হয়েছে। বাংলাদেশেও চলছে সাধারণ ছুটি। এখানেও অনেকটা লকডাউনের মতো পরিস্থিতি। বিভিন্ন জেলা ও বিভাগ একের পর এক লকডাউন করা হচ্ছে। গত ১৩ এপ্রিল সিলেটের অন্যান্য জেলার মতো মৌলভীবাজারেও লকডাউন ঘোষণা কর হয়। ঠিক এমন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছেন দিনমজুর মনা মিয়া।

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, ফুলতলা ইউনিয়নের প্রবেশমুখে অর্থাৎ প্রধান সড়কে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধের জন্য স্থানীয়দের উদ্যোগে ফটক দেওয়া হয়েছে। মনা মিয়া দিনরাত কষ্ট করে সেই ফটক পাহারা দিচ্ছেন। এ সময় যানবাহন প্রবেশের সময় প্রতিটি গাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটিয়ে দিচ্ছেন তিনি।

তার এই মানবসেবা দেখে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। পাশাপাশি সরকার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে অনুরোধ করছেন তাকে যেন সহযোগিতা করা হয়।

ফুলতলা ইউনিয়নের বাসিন্দা রহমান বলেন, মনারাই এই দেশের সুনাগরিক। দেশের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। দেশের সুসময়ে তারা অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হলেও দেশের দুঃসময়ে তারাই অগ্রসারিতে।

পার্শ্ববর্তী এলাকার আহসান তামিম বলেন, পেশায় মনা একজন দিনমজুর। এই মানুষটি নিঃস্বার্থভাবে এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে যা সত্যিই অতুলনীয়। সকলের কাছে শুধু একটিই চাওয়া- বিপদের সময় মনাদের মতো যে সমস্ত মানুষ আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, পরবর্তী সময়ে আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই।

মনা মিয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম। রেস্টুরেন্ট বন্ধ হওয়ায় এখন আর কোনো কাজ নেই। সারাদিন বাড়িতে বেকার বসে থাকতে হয়। তাই এই কাজটি মানবসেবা হিসেবে বেছে নিলাম। আমি প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২/১টা পর্যন্ত এখানে থাকি।

তিনি বলেন, ফুলতলা ইউনিয়ন থেকে আমাকে এই জীবাণুনাশক স্প্রেগুলো দেওয়া হয়েছে। রাস্তা দিয়ে যে গাড়ি যায়, ওই সকল গাড়ির পুরো বডিতে বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই জীবাণুনাশক স্প্রে করি। তরপর পাহারা দেই বহিরাগত কেউ যাতে এলাকায় না ঢুকে। আমি অনেক বহিরাগতকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।

তিনি জানান, ইউনিয়নের পাশেই তার বাড়ি। অনেকদিন আগে তার বাবা না ফেরার দেশে চলে গেছেন। এখন এক সন্তান, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে কোনোমতে দিন পার করছেন তিনি। রেস্টুরেন্টে কাজ করে যা উপার্জন করতেন, তা দিয়ে কোনোমতে চলা যেত। কিন্তু করোনার কারণে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা এখন গৃহবন্দি। মনা মিয়া অন্য কোনো কাজও করতে পারছেন না। তাই কিছু না করতে পেরে নেমেছেন মানবসেবায়। এই মুহূর্তে তার কাছে কোনো টাকা নেই। ঘরের সঞ্চিত খাবারও শেষ হয়ে গেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত কয়েকদিন আগে ইউনিয়ন থেকে ৩ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ২ কেজি ডাল আর ১টি সাবান পেয়েছেন। তা দিয়ে কয়েকদিন চলা যাবে। পরে কী করবেন জানেন না।

ফুলতলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইমতিয়াজ গফুর মারুফ বলেন, মনা মিয়ার বিষয়ে আমি অবগত আছি। সে ইউনিয়নের জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটিয়ে দিচ্ছে, এলাকার লকডাউন গেট পাহারা দিচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিষদের ত্রাণ সীমিত। সে কারণে সেভাবে সহযোগিতা করা যাচ্ছে না। এরপরও যখনই ত্রাণ আসছে, তাকে আমরা ত্রাণ দিচ্ছি।

এ বিষয়ে ফুলতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মাসুক আহমদ বলেন, ইউনিয়নেr জন্য সে ভালো একটি কাজ করে যাচ্ছে। এটি সত্যিই প্রশংসনীয়। তার জন্য আমি আবারও দ্রুত ত্রাণের ব্যবস্থা করছি।

 

এসএইচ/আরআর