দুই দশকে সিলেটে নিশ্চিহ্ন শতাধিক টিলা

নিজস্ব প্রতিবেদক


জুন ০৭, ২০২১
১২:৪৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জুন ০৭, ২০২১
১২:৪৩ পূর্বাহ্ন



দুই দশকে সিলেটে নিশ্চিহ্ন শতাধিক টিলা

পাহাড়-টিলা ধ্বংসের প্রতিবাদে জৈন্তাপুরের বটলতায় মানববন্ধন চলছে। ঠিক তখন সামনে দিয়ে কয়েকটি মাটিভর্তি ট্রাক বেরিয়ে যায়। উপজেলার গোয়াবাড়ী এলাকায়টিলা কেটে এসব মাটি সরানো হচ্ছিল। এভাবে অবাধে কাটা হচ্ছে সিলেটের পাহাড়-টিলা। পরিবেশের ছাড়পত্রের তোয়াক্কা না করেই সিলেট নগরের আশপাশ ও জেলার বিভিন্ন স্থানে দেদারছে টিলা কাটা চলছে। 

গোলাপগঞ্জের বাঘা ইউনিয়নে বোরহান উদ্দিন সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে একটি বাজার। অধীরের দোকান নামের এই বাজারেরপ্রায় অর্ধেক ছিল ছোট-বড় টিলা। টিলাগুলো নিশ্চিহ্ন করে গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, কোথাও গোপনে, কখনও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আবার কখনও প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতায় এ অঞ্চলের পাহাড়-টিলা কেটে অর্ধেক করা হয়েছে। 

শুধু বাঘা ইউনিয়নই নয়; গোলাপগঞ্জ উপজেলা, সিলেট সদর, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাটসহ উপজেলাসহ বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে টিলা কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে ইট-পাথরের দালান। 

পরিবেশবিদরা বলছেন, একসময় সিলেট শহর ও আশপাশের শাহী ঈদগাহ, টিবি গেট, বালুচর, বিমানবন্দর এলাকা, মেজরটিলা, খাদিমপাড়া, লাক্কাতুরা, শাহপরান, বটেশ্বর, পাঠানটুলা এলাকায় অসংখ্য পাহাড় ও টিলা ছিল। গত তিন দশকে সিলেটে প্রায় অর্ধেক টিলা সাবাড় হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সিলেট অচিরেই টিলাশূন্য হয়ে পড়বে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এর তথ্য অনুযায়ী, সিলেট সদর, গোলাপগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি টিলা কাটা হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসন। এতে ভূমিধ্বসসহ দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। 

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত ১৩৭ দশমিক ৫০ একর জায়গায় শাহ আরেফিন টিলা। লালচে, বাদামি ও আঠালো মাটির এ টিলার নিচে রয়েছে বড় বড় পাথর খণ্ড। খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে বিশাল এ টিলা। বর্তমানে টিলার বাইরের খোলসটাই কেবল রয়েছে, ভেতরে মাটি খুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত। 

পরিবেশ অধিদপ্তরের বলছে, গত দেড় দশকে সিলেটের ৬১টি টিলা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জেলার ৪১২টি পাহাড়-টিলার মধ্যে এখন টিকে আছে সাড়ে ৩শ। তবে পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনগুলো এই পরিসংখ্যান মানতে নারাজ। তারা বলছে, গত দুই দশকে শতাধিক টিলা সিলেট থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘গত তিন দশকে সিলেট নগরের ৫০ভাগ টিলা ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে গত দেড় শতকে একশ’র বেশি টিলা নিশ্চিহ্ন হয়েছে।’ 

‘নগরের করের পাড়া, বালুচর, বাদামবাগিচা, বনকলাপাড়া, জালালাবাদ, বিমানবন্দর, শাহী ঈদগাহ, তারাপুর এলাকা, মেজরটিলা, শাহপরান এলাকায় সবচেয়ে বেশি কাটা হচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে অবহিত করা হলে তারা কার্যকর উদ্যোগ নেন না। বরং, প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় লিয়াঁজো করে আরও দাম্ভিকতার সঙ্গে পাহাড়খেকোরা সক্রিয় হয়ে উঠে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের নভেম্বরে সিলেটে সব ধরনের পাহাড়-টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন উচ্চ আদালত। এছাড়া পরিবেশ আইনেও পাহাড়-টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যদিও আইন-আদালতের এসব বিধি-নিষেধের কোনো তোয়াক্কাই করছে না পাহাড়খেকোরা। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা বলেন, ‘টিলা কাটার ব্যাপারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তার পরও টিলা কাটা বন্ধ হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘টিলা কাটা বন্ধে অনেকবার আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের চিঠি দিয়েছি। মাঝে মধ্যে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উদাসীনতার কারণে আমরা পাহাড়-টিলা রক্ষা করতে পারছি না। এ বিষয়ে জনগণেরও সচেতন হওয়া উচিত।’

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ‘পাহাড় কাটা আইনগতভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ। এমন কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। গত এক বছরে এরকম দু’টি ঘটনায় সরাসরি অভিযান পরিচালনা করে ৩ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এনফোর্সমেন্ট পরিচালনা করে টিলা কাটার দায়ে ৩৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৮৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’ 

পরিবেশ অধিদপ্তরের এই তথ্য থেকে অনুমান করা যায়, সিলেটে কত হারে পাহাড় ও টিলা কাটা হচ্ছে। কারণ, এক বছরে ৩৬টি টিলা কাটার ঘটনায় জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর বাইরে কয়েকগুণ বেশি টিলা কাটার ঘটনা ঘটেছে গত এক বছরে। 

এসএইচ/আরসি-০১