হাওরে মিলে না জরুরী চিকিৎসা, সংকট নিরাপদ পানির

শামস শামীম


আগস্ট ৩০, ২০২১
১২:৩২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ৩০, ২০২১
১২:৩২ পূর্বাহ্ন



হাওরে মিলে না জরুরী চিকিৎসা, সংকট নিরাপদ পানির
নেই স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন

টাঙ্গুয়ার হাওরের গ্রামগুলো বছরের অর্ধেক সময়ই পানিবন্দি থাকে। প্রাকৃতিক এই ব্যবস্থাকে বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই এলাকাবাসী যাপিত জীবনে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন চিরায়ত বঞ্চনার সঙ্গে। উপজেলা, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা কমিউনিটি ক্লিনিক দূরে থাকায় এই হাওরবাসী জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসাও নিতে পারেন না বর্ষা ও হেমন্তে। এ সময় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের দুর্ভোগ হয় বেশি। বিশেষ করে প্রসূতি নারীদের কষ্টের সীমা থাকে না।

চারদিকে থৈ থৈ পানি থাকলেও নিরাপদ পানি পান থেকেও বঞ্চিত তারা। গ্রামগুলোর বেশিরভাগ মানুষই খোলা পায়খানা ব্যবহার করেন। প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর পরিবেশে অবস্থান করেও তারা ন্যুনতম সুবিধাবঞ্চিত যুগ যুগ ধরে। এ অবস্থায় গ্রামবাসী স্বাস্থ্যসম্মত কমিউনিটি পায়খানার ব্যবস্থা, নিরাপদ পানি পানের ব্যবস্থা গ্রহণ ও বর্ষায় জল-অ্যাম্বুলেন্স প্রদানের দাবি জানিয়েছেন। 

১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত পর্যন্ত ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদাররা মৎস্যসহ টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্পদ আহরণ করতেন। পরে মৎস্য আহরণের জন্য কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর গ্রামের মহানন্দ দাস সরকারের কাছ থেকে হাওর বন্দোবস্ত নেন। ওই সময়েই টাঙ্গুয়ার হাওর লাভজনক জলমহাল হিসেবে গড়ে ওঠে। সেই থেকে ইজারা ব্যবস্থায় চলে যায় জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ এ হাওরটি।

এরপর জলমহাল হিসেবে সরকারের অধীনে চলে যায় এটি। তারপর ক্ষমতাবলে বৈধ-অবৈধভাবে টাঙ্গুয়া ইজারা নিয়ে কোটিপতি হওয়ার হিড়িক পড়ে স্বাধীনতার পর থেকেই। ইজারাদারদের ওয়াটার লর্ড হিসেবে ডাকতেন স্থানীয়রা। বেপরোয়াভাবে মৎস্য আহরণ করায় গাছ, মাছ ও উদ্ভিদশূন্য হয়ে পড়ে হাওরটি। তাই ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওর সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে রামসার সাইট ঘোষিত হয়। তবে পূর্বের সম্পদ ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও সম্পদ আরও নষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। 

২০০৩ সাল থেকে মাদার ফিশারিজ টাঙ্গুয়ায় ইজারা প্রথা বন্ধ রয়েছে। ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিতদের ম্যানেজ করে বিভিন্ন গ্রামের সুবিধাভোগী মাছ লুট করত- এমন অভিযোগ আছে। স্থানীয় সাধারণ মানুষ ইজারাদারের মতো ব্যবস্থাপনার সময়ও বঞ্চিত হন। স্থানীয়দের ভাগ্যোন্নয়নে ইজারাদাররাও কোনো কাজ করেনি। তারা কেবল বেপরোয়া সম্পদ আহরণ করে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে।

২০০৩ সাল থেকে ব্যবস্থাপনার সময়ে ‘বাইচ্যা’ (নৌকার নিয়োগকৃত চালক) গ্রামগুলোতে মাছ ধরার সিন্ডিকেট গড়ে হাওরের মাছ লুট করেছিল। ওই সময়ে যারা পেশাদার মৎস্যজীবী ছিলেন, তারা এলাকা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন। তাছাড়া ওই সময়ে ব্যবস্থাপনায় জড়িত কমিউনিটি গার্ডদের নেতৃত্বে টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্পদ লুণ্ঠনে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল বলে এলাকাবাসী বিভিন্ন ফোরামে অভিযোগ করে আসছিলেন। 

সরেজমিনে টাঙ্গুয়ার হাওরের জয়পুর, ছিলাইন তাহিরপুর, রনচি, মন্দিআতা, গোলাবাড়ি গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এসব গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই দরিদ্র। মাছ ধরায় বাধাদানের পর থেকেই এসব গ্রামের মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল লোকজন এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। যারা রয়ে গেছেন, তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এর সঙ্গে নিরাপদ পানি পান ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাবে নানা পানিবাহিত রোগে ভুগছেন তারা। এছাড়া প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাও পাচ্ছেন না অবহেলিত গ্রামের সাধারণ মানুষজন। 

মন্দিআতা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আলী রেজা বলেন, আমাদের গ্রামসহ টাঙ্গুয়ার হাওরের কেন্দ্রে অবস্থিত গ্রামগুলোর মানুষ খুবই অসহায় ও হতদরিদ্র। প্রাকৃতিক কারণে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থায় জরুরি সময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারি না। তাই অনেকেরই জীবনহানি ঘটে। আমাদের এলাকার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও কমিউনিটি ক্লিনিকেও আমরা নিয়মিত সেবা পাই না। চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ পাই না। 

ওই গ্রামের বাসিন্দা ইউপি সদস্য সাজিনুর মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামে ২ হাজারেরও বেশি মানুষের বাস। কিন্তু মাত্র ৭টি নলক‚প আছে। অবস্থাসম্পন্ন কয়েকটি পরিবার স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করে। নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারের অভাবে আমরা পানিবাহিত রোগে ভুগছি। স্থানীয় চেয়ারম্যানকে বলেও আমরা সমতার ভিত্তিতে নলক‚প পাই না। আমাদের বিশুদ্ধ পানির খুবই অভাব। এই হাওরের অন্য গ্রামগুলোর অবস্থাও একইরকম। 

মোয়াজ্জেমপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি শামসুন্নাহার বলেন, বর্ষায় আমাদের ক্লিনিক পানিবন্দি থাকে। আমাদের ক্লিনিকে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়। এ সময় হাওরের আফাল (ঝড়) ঠেলে ক্লিনিকে আসতে পারেন না রোগীরা। তাছাড়া চাহিদার তুলনায় ওষুধের অপ্রতুল বরাদ্দের কারণেও আমরা অনেক সময় কাঙ্খিত সেবা দিতে পারি না। তবে আমরা এখন সাধারণ অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা প্রদানসহ কমিউনিটি ক্লিনিকে নিরাপদ ডেলিভারিও করিয়ে থাকি। 

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান খসরুল আলম বলেন, আমার ইউনিয়নের গ্রামগুলোর মানুষ খুবই অভাবী। গ্রামগুলোতে নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাব আছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারণে জরুরি সময়ে দ্রæত স্বাস্থ্যসেবাও নিতে পারেন না মানুষজন। আমরা যে অল্প বরাদ্দ পাই, তা দিয়ে নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ করতে পারি না। টাঙ্গুয়ার হাওরের গ্রামগুলোর এসব কাজের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দরকার। 

জেলা গণস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, হাওরাঞ্চলের জন্য সরকার নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সুনামগঞ্জসহ ৭টি হাওর জেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের গ্রামগুলো এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলে আমি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানাব। তাছাড়া আমি নিজেও খোঁজ নিয়ে বরাদ্দের বিষয়ে উদ্যোগ নেব।

আরসি-০১