ভাষা আন্দোলন ও আব্দুস সামাদ আজাদ

আহমেদ নূর


ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২
১০:৪৮ অপরাহ্ন


আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২
১০:৪৮ অপরাহ্ন



ভাষা আন্দোলন ও আব্দুস সামাদ আজাদ
জন্মশতবর্ষ স্মরণ

বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় মহান ভাষা আন্দোলন। সিলেটে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের অনেক আগে থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ভাষার দাবিতে সারাদেশে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ খিষ্টাব্দ থেকে। কিন্তু সিলেটের মানুষ ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই তাদের অসন্তোষ প্রকাশ শুরু করেন। 

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদাদানের দাবিতে সিলেটে প্রকাশ্যে সভাও অনুষ্ঠিত হয় সে সময়। সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বিষয় নিয়ে ১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর, ৩০ নভেম্বর এবং ২৮ ডিসেম্বর পরপর তিনটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। ৩০ নভেম্বরের আলোচনা সভাটি স্থানীয় আলীয়া মাদ্রাসা হলে অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খ্যাতিমান সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। কিন্তু তাঁর বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই উর্দু সমর্থকরা হামলা চালিয়ে সভাটি পণ্ড করে দেয়। অবশ্য পরবর্তীসময়ে মুজতবা আলীর এই প্রবন্ধটি আল ইসলাহ এবং কলকাতার চতুরঙ্গ পত্রিকায় ছাপা হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় পরে মুজতবা আলীকে দেশ ছাড়তে হয়।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিলেটের পত্রপত্রিকায়ই প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উঠে। এক্ষেত্রে আল ইসলাহ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয় ভাষা আন্দোলনে সিলেটের নারীরা অনন্য ভূমিকা পালন করেন। যা আজ ইতিহাসের অংশ। আর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের পর সিলেটের রাজপথ ছিল মিছিল সমাবেশে উত্তাল। শুধু জেলা শহর নয় থানা (বর্তমান উপজেলা) এমনকি গ্রাম পর্যায়েও এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেটের কৃতী সন্তান আব্দুস সামাদ আজাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন। সিলেটে এবং ঢাকায় আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঢাকায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্যও ছিলেন তিনি। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার দায়ে তিনি গ্রেপ্তার হন ও কারাবরণ করেন।

আব্দুস সামাদ আজাদ ১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার প্রত্যন্ত অঞ্চল ভুরাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র অবস্থায়ই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে তিনি সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হন। পরে অবিভক্ত আসামের মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে তিনি সিলেট এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু সরকারবিরোধী রাজনীতির কারণে মাস্টার্স শেষ পর্বের পরীক্ষা তাঁকে দিতে দেওয়া হয়নি। 

এ বছর আব্দুস সামাদ আজাদের শততম জন্মবার্ষিকী। একই সঙ্গে মহান ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরপূর্তি। আব্দুস সামাদ আজাদ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলে ইতিহাস পাঠে অনেকের হয়ত খটকা লাগবে। কারণ আব্দুস সামাদ আজাদের প্রকৃত নাম ছিল মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি নামের শেষে আজাদ শব্দটি যুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত তিনি মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ কিংবা এম.এ. সামাদ নামেই পরিচিত ছিলেন। কোথাও কোথাও মোহাম্মদ এ সামাদ বা শুধু আব্দুস সামাদ নামেও তাঁর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সুতরাং ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে তাঁর নামের সঙ্গে আজাদ শব্দটি যুক্ত ছিল না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়েও আব্দুস সামাদ নামে তাঁর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।

১৯৪৮ সালের ১১ জানুয়ারি পাকিস্তানের যোগাযোগ মন্ত্রী আবদুর রব নিশতার সিলেট এলে আব্দুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে একটি ছাত্র প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তখন সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি। প্রতিনিধি দল মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে পূর্ব বাংলার শিক্ষার মাধ্যম ও আদালতের ভাষা রূপে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিতকরণের দাবি জানান। একইদিন মহিলা মুসলিম লীগ সিলেট জেলা শাখার সভানেত্রী বেগম জোবেদা খাতুনের নেতৃত্বে একটি মহিলা প্রতিনিধি দলও মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।

একই বছর ৮ মার্চ শহরের গোবিন্দচরণ পার্কে (বর্তমানে হাসান মার্কেট) তমদ্দুন মজলিস ও সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে এক সভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু একটি গোষ্ঠী হামলা চালিয়ে সেই সভাটি পÐ করে দেয়। হামলায় আব্দুস সামাদ আজাদসহ বেশ কজন আহত হন। এই হামলার সংবাদ সাপ্তাহিক নওবেলাল ১১ মার্চ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ সংখ্যায় বিস্তারিত প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়

 ৮ই মার্চ সিলেটে তমদ্দুন মজলিস এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে সিলেটের গোবিন্দ পার্কে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। এই সভার উদ্দেশ্য ছিল নাজিমুদ্দীন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তাঁর এই প্রতিশ্রুতিকে কার্যে পরিণত করার দাবি জানানো। সভাটিতে সভাপতিত্ব করেন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রাক্তন সম্পাদক মাহমুদ আলী। সভার কাজ শুরু হওয়ার ঠিক পরেই কয়েকজন লোক ‘উর্দু পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হোক’ এই বলে চিৎকার করে ওঠে। পর মুহূর্তেই দুস্কৃতকারীদের মধ্যে একজন সভাপতির চেয়ার দখল করে তাতে বসে পড়ে এবং আবদুল বারী (ধলা) নামে গুন্ডা প্রকৃতির এক ব্যক্তি টেবিলের উপর চড়ে আবোল তাবোল বক্তৃতা শুরু করে। এইভাবে আবদুল বারী এবং তার অন্যান্য সহযোগী গুন্ডারা সভায় বাংলা ভাষার সমর্থকদেরকে বক্তৃতাদানে বাধা দিতে থাকে। শুধু তাই নয় তারা সেই সঙ্গে সভাপতি মাহমুদ আলী, নওবেলালের প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ আজরফ, পাকিস্তান মুসলিম লীগের সদস্য ও সিলেট তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক দেওয়ান অহিদুর রেজা এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সামাদকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছুড়ে এবং কয়েকজন ছাত্রকে প্রহার করে। এরপর তারা অধিকতর উগ্র মূর্তি ধারণ করে টেবিল চেয়ার লাথি মারতে থাকে এবং একজন পাকিস্তানের পতাকা পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলে। গুন্ডাদের এই আচরণে সমবেত জনসাধারণ খুব ক্রুদ্ধ এবং বিক্ষুব্ধ হযে উঠে তাদেরকে পাল্টা আক্রমণে উদ্যত হয়। পুলিশ উপস্থিত থাকা সত্তে¡ও হাঙ্গামা আয়ত্তে আনা অসম্ভব হয়ে পড়লে সভাপতি তাড়াতাড়ি কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণের পর সভা ভঙ্গ করে দেন। 

মূল সভা ভেঙে দেওয়ার পর উপরোল্লিখিত আবদুল বারীর সভাপতিত্বে অন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সিলেট মুসলিম লীগের নেতা আজমল আলী বক্তৃতার মাধ্যমে নানা মিথ্যা প্ররোচনার দ্বারা কিছু লোককে এমন উত্তেজিত করে তোলেন যে, তারা গোবিন্দ পার্কের বাইরে এসে তমদ্দুন মজলিসের সদস্য ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের নেতা মকসুদ আহমদকে অমানুষিক প্রহার করে। এই প্রহারের ফলে তিনি মুর্ছিত হয়ে পড়েন।

(সূত্র : বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খন্ড ১৯৭০, পৃষ্ঠা ৬৫)


এই ঘটনা সাধারণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সিলেট জেলা মহিলা মুসলিম লীগ এই ঘটনার প্রতিবাদে ১০ মার্চ একইস্থানে একটি সভা আহবান করে। যদিও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারির কারণে সভাটি হতে পারেনি। শহরের বিশিষ্টজনরাও হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন। আয়োজক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক দেওয়ান অহিদুর রেজা এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আব্দুস সামাদ (আজাদ) স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়

আমরা আজাদ পাকিস্তানে প্রত্যেকের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ দান করিবার জন্য বহুযুগের দাসত্বের অবসান ঘটাইয়াছি। তাহা প্রমাণ করার সময় আসিয়াছে। কিন্তু আজ আমরা সিলেটবাসী অরাজকতার দৌরাত্ম্য আর কতদূর সহ্য করিব। তাই আমাদের নিবেদন, আপনারা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে কোনঠাসা করিয়া, অরাজকতাকে আর কত প্রশ্রয় দিবেন? আজ আমাদের জাতীয় সম্মান লাঞ্ছিত ও অপমানিত।  

[..] সিলেটে গুন্ডামির নগ্ন রূপ বহুদিন হইতে সিলেটবাসী জনসাধারণের অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। জনাব নিশতার সাহেব যখন সিলেট পরিদর্শনে আসেন তখন আমরা গুন্ডামির বেপরোয়া নমুনা লক্ষ্য করিয়াছিপাকিস্তান সরকার এই অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার করেন নাই। তাই দিন দিন গুন্ডা প্রভাব জনমতকে ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ভয় দেখাইয়া গোলমাল সৃষ্টি করে ও অভদ্র ব্যবহার দ্বারা কণ্ঠরোধ করিতে চায়। আমরা ইহার আশু প্রতিকার দাবি করিতেছি। 

(সূত্র : বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৬৬)


আব্দুস সামাদ আজাদ ১৯৪৮ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে ঢাকায় চলে যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন তিনি ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে যুক্ত হন। সে সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সোচ্চার ছিলেন। সভা, সমাবেশ মিছিলসহ সব কর্মসূচিতেই তাঁর উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। আন্দোলন ঠেকাতে তৎকালীন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলেও ছাত্র জনতাকে নিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে তিনি সম্মুখ সারিতে ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত ও জব্বার। আহত হন অনেকে। সেদিনের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে গিয়ে অন্য অনেকের সঙ্গে আব্দুস সামাদ আজাদও গ্রেপ্তার হন। তার আগে ২০ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে যে ১১ জন ছাত্রনেতা এক সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত হন তাদের একজন ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে যার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিনি ভাষা সৈনিক গাজীউল হক। ২১ ফেব্রুয়ারির সেই ঐতিহাসিক সমাবেশে তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন রাতের তৎপরতা সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গাজীউল হক বলেন

রাত প্রায় ১টায় ফজলুল হক হলের এবং ঢাকা হলের মধ্যবর্তী পুকুরের পূর্বপাড়ে সিঁড়ি বাঁধানো পাকা ঘাটের ওপর আমরা ১১ জন ছাত্র মিলিত হই। ওই ১১ জন ছাত্রের মধ্যে হাবিবুর রহমান শেলী (বার এট ল), কমরুদ্দীন শহুদ, মোস্তাফা রওশন আখতার (মুকুল), এস এ বারী এটি, জিল্লুর রহমান (বর্তমানে অ্যাডভোকেট), আনওয়ারুল হক খান, আব্দুস সামাদ প্রমুখ ছিলেন। বাকি জনের নাম আজ স্মরণ করতে পারছি না। ওই বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আমাদের যুক্তি ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করা হলে চিরতরে ভাষা আন্দোলনের কবর রচনা করা হবে।

পুকুর পাড়ের ওই ছাত্র বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় : (১) ২১শে ফেব্রুয়ারি ভোরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের চিঠি দিয়ে ৪ জন ৪ জন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েতের ব্যবস্থা করতে হবে। চিঠি নেওয়ার দায়িত্ব আমার ওপর দেওয়া হয়।

(২) ২১শে তারিখের বিশ্ববিদ্যালয়ের সভায় আমাকে সভাপতিত্ব করতে হবে। আর আমি যদি গ্রেফতার হয়ে যাই, তবে কমরুদ্দীন আহমদ সভাপতিত্ব করবেন। সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে সভাপতি হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করবে মোস্তাফা রওশন আখতার ওরফে মুকুল (মুস্তাফা নূরউল ইসলামের ছোট ভাই) এবং সমর্থন করবেন কমরুদ্দীন আহমদ। আমাদের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ হলো, ছাত্রলীগ থেকে সভাপতি হলে, হয়তো ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে সভাপতি রায় দিতে পারে এই আশঙ্কায়। ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত মোতাবেক সমস্ত কার্য অনুষ্ঠিত হয়। মোস্তাফা রওশন আখতার আমার নাম প্রস্তাব এবং কমরুদ্দীন শহুদ সমর্থন করেন। ছাত্রলীগ থেকে কোনো আপত্তি উত্থাপিত হয়নি।

২১শে ফেব্রুয়ারিতে আমতলার সভায় বক্তৃতা করেন (১) তদানীন্তন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক সামছুল হক, (২) আবদুল মতিন, (৩) আব্দুস সামাদ এবং সভার সভাপতি। 

(সূত্র: বদরুদ্দীন উমর, ‘ভাষা আন্দোলনে গাজীউল হক’ । দৈনিক সমকাল ১৯ জুন ২০০৯)


এখানে একটি বিষয় প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখযোগ্য যে, একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা যে মিছিলটি বের করেন তাতে আব্দুস সামাদ আজাদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সভায় কয়েকজন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করলেও আব্দুস সামাদ আজাদসহ অন্যরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেন। যখন সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো তখন কীভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা যায় সেই দিক নির্দেশনাও তিনি দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ‘দশ জনের’ মিছিল এখন ইতিহাসের অংশ। এই ‘দশ জনী’ মিছিলের প্রস্তাবক ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বিষয়টি এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে

 সভা প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর অবশেষে গাজীউল হক সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সপক্ষে মত প্রকাশ করে তিনি বলেন যে, এভাবেই তারা নূরুল আমীন সরকারের চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে চান।  [...] সভাপতি গাজীউল হক কর্তৃক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় সমবেত ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেন এবং ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। এই সময় আব্দুস সামাদ প্রস্তাব করেন যে, কিছুটা সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য ১০ জন করে এক এক ব্যাচ বের হওয়া দরকার, কারণ সকলে এক সঙ্গে বের হতে চাইলে চারদিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। প্রস্তাটি গৃহীত হলে সভা শেষ হয় এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় গেটের সামনে সমবেত হতে শুরু করেন। সময় তখন ছিলো বেলা ১১টা। 

(সূত্র: বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৬৯)


ভাষা আন্দোলনে আব্দুস সামাদ আজাদের ভূমিকা সম্পর্কে ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের মতো একই বক্তব্য প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ.এম.এস. কিবরিয়ার মুখ থেকেও আমরা পাই। শাহ কিবরিয়া তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারির আমতলার সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন। সেদিনের পরিস্থিতি এবং আব্দুস সামাদ আজাদের ‘দশ জনী’ মিছিলের প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন

[...] সভাপতি হিসেবে গাজীউল হকের বক্তব্য ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্তকেক চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। এ সময় সবাই উত্তেজিত হয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য স্লোগান দিতে থাকেন। এই অশান্ত পরিবেশে শ্রদ্ধেয় আব্দুস সামাদ আজাদ প্রস্তাব করেন যে, দশ জনের দল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। তুমুল করতালির মধ্যে এই প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং এর পরই সভা শেষ হয়ে যায়। সবাই তখন গেটের দিকে এগিয়ে যায়।

(সূত্র: শাহ এ.এম.এস. কিবরিয়া, একুশের স্মৃতি, মৃদুভাষণ, পৃষ্ঠা ৮)


বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এই উদ্যোগের সঙ্গেও আব্দুস সামাদ আজাদ সম্পৃক্ত ছিলেন। দিবসটি পালনে সরকারের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে আব্দুস সামাদও প্রতিনিধি দলে ছিলেন। শহীদ দিবস পালনের প্রস্তুতি যখন শেষ পর্যায়ে ঠিক তখন (১৮ ফেব্রুয়ারি) সরকার ছাত্রনেতাদের সচিবালয়ে ডেকে পাঠায়। সংগ্রাম পরিষদ থেকে আব্দুস সামাদ (আজাদ), মোহাম্মদ সুলতান (ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি), আখতার উদ্দিন, শামসুল হক, জিল্লুর রহমান (মুসলিম ছাত্র লীগ), ইব্রাহিম তাহা (ইসলামিক ব্রাদারহুড) ও গাজীউল হককে প্রতিনিধি করে পাঠানো হয়। সরকার পক্ষে ছিলেন, টিফ সেক্রেটারি মোহাম্মদ ইসহাক, আইজি দোহা এবং জিওসি মেজর জেনারেল আদম। দুপক্ষে উত্তপ্ত আলোচনা হলেও সবশেষে সমঝোতা হয় যে, সরকার মিছিলে বাধা দেবে না এবং পুলিশও গাড়ি নিয়ে মিছিলের আগে পিছে থাকবে না। ছাত্ররাও আশ্বাস দেয় মিছিল শান্তিপূর্ণ হবে, কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। আলোচনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ ফেব্রæয়ারি শহীদ দিবসের কর্মসূচি যথাযথভাবে পালিত হয়। 

(সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, ১৮৩০ থেকে ১৯৭১, পৃষ্ঠা ১৭৯)


বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও আব্দুস সামাদ আজাদ অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। যুদ্বকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকার গঠনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকারে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূত। যুদ্ধে বিজয় লাভের পর ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর আব্দুস সামাদ আজাদ মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি গঠিত মন্ত্রীসভায় আব্দুস সামাদ আজাদ পুনরায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির যাত্রা শুরু হয়। 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। এ সময় আব্দুস সামাদ আজাদকে এক সপ্তাহ গৃহবন্দি করে রাখার পর ২২ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করে জাতীয় চার নেতার সঙ্গে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। কারাগারে থাকাবস্থায়ই সামরিক আদালতে আব্দুস সামাদ আজাদের বিচার করা হয় এবং তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দন্ডিত করা হয়। চার বছর কারাভোগের পর ১৯৭৯ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। 

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে তিনি সাত বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমÐলীর সদস্য ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য আব্দুস সামাদ আজাদকে ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। জন্মশতবার্ষিকীতে প্রয়াত এই ভাষা সৈনিককে সশ্রদ্ধ অভিবাদন। 


লেখক- সম্পাদক, দৈনিক সিলেট মিরর