সিলেট মিরর ডেস্ক
আগস্ট ০৪, ২০২৫
১১:৩১ অপরাহ্ন
আপডেট : আগস্ট ০৪, ২০২৫
১১:৩৩ অপরাহ্ন
গান্ডারবালের শ্রীনগর-লেহ মহাসড়কে গগঙ্গীর এবং সোনামার্গকে সংযুক্তকারী সজ্জিত 'জেড-মোর' সোনমার্গ সুড়ঙ্গের একটি দৃশ্য।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট, ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে। এর ফলে অঞ্চলটি দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়—জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। এই পদক্ষেপ তখন যেমন সমর্থন পায়, তেমনি তীব্র বিরোধিতার মুখেও পড়ে। এর প্রায় ছয় বছর পর আজ যখন এই অঞ্চলের উন্নয়ন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নের সময় এসেছে, তখন স্পষ্টভাবে দুটি ভিন্ন চিত্র সামনে আসে: একদিকে ভারতীয় অংশে ধীরে ধীরে উন্নয়ন, পরিকাঠামো ও পর্যটনের প্রসার ঘটছে; অন্যদিকে পাকিস্তান অধিকৃত আজাদ কাশ্মীরে বিরাজ করছে দারিদ্র্য, দমননীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক করুণ বাস্তবতা।
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে উল্লেখযোগ্য অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর বিক্ষোভের সহিংস দমনের কারণে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। |
প্রথম দিকে ভারত-অধিভুক্ত জম্মু ও কাশ্মীরে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা, নেতাদের গৃহবন্দি, এবং সেনা মোতায়েন সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করলেও সময়ের সাথে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো উন্নয়নে কেন্দ্রীয় তহবিল সরাসরি বরাদ্দ পাচ্ছে অঞ্চলটি। পর্যটন শিল্পে নজিরবিহীন বৃদ্ধি, যেমন গুলমার্গ ও পাহালগামের মতো এলাকাগুলোতে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আগমন আবারও শুরু হয়েছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি শক্তিশালী করতে ‘এক জেলা এক পণ্য’ প্রকল্প, রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণ, এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ফলে একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত রূপান্তর পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তিন দশক ধরে চলা ইসলামি বিদ্রোহে বিপর্যস্ত এই অঞ্চলে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার আশায় ভারত জি-টোয়েন্টি দেশগুলোর পর্যটন কর্মকর্তাদের কাছে কাশ্মীরকে তুলে ধরছে। ৫ আগষ্ট ২০২৪ সালের আগের দুই বছরে কাশ্মীরে বাংলাদেশী পরর্যটক ছিল তৃতিয় অবস্থানে।
তারপরও কিন্তু সবকিছুই যে নিখুঁত—তা বলা যাবে । সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি এখনও দৃশ্যমান। বিভিন্ন গণআন্দোলন ও বিক্ষোভে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কঠোর দমননীতি এবং বিরোধী রাজনীতিকে উপেক্ষা করা জনসাধারণের মধ্যে আস্থার ঘাটতি সৃষ্টি করেছে। তবুও, বিগত বছরগুলোতে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যখাতে সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে অঞ্চলটি একটি নতুন পথে হাঁটছে, এ সত্য অস্বীকার করা যায় না।
এই দুই কাশ্মীর—একই ভূখণ্ড, দুই প্রশাসনিক বাস্তবতা। একদিকে গণতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আগ্রসরমান একটি সমাজ, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা ও নাগরিক অধিকারের চরম সংকটে নিমজ্জিত একটি বঞ্চিত জনগোষ্ঠী।
ভারতের অংশের কাশ্মীরে যে উন্নয়ন চলছে তার উল্টোদিকে পাকিস্তান-অধিকৃত আজাদ কাশ্মীরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও অঞ্চলটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্বায়ত্তশাসিত’ বলা হয়, বাস্তবে তা ইসলামাবাদ ও দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার শক্ত নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি, রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, এবং নিয়মিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সেখানে যেন নিয়মিত চিত্র। ২০২৪ সালের মে মাসে বিদ্যুৎ ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ছড়িয়ে পড়া গণআন্দোলন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে রক্তাক্ত হয়। একপর্যায়ে জনগণের চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার প্রায় ২৩ বিলিয়ন রুপি ভর্তুকি বরাদ্দ দিতে বাধ্য হয়।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই সাময়িক ত্রাণ কি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক দিশাহীনতার প্রতিকার হতে পারে? বাস্তবতা হলো, আজাদ কাশ্মীরে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, রাস্তাঘাট, কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কোনো কার্যকর উন্নয়ন নেই। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এখানকার মানুষ প্রায়ই গোলাবর্ষণের শিকার হয়। সীমান্তে নিয়োজিত সেনাদের নজরদারি এবং দমনমূলক নীতি জনগণের মনে অনিরাপত্তা তৈরি করে রেখেছে। নাগরিক অধিকার একপ্রকার অলীক স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে নয়, বরং স্বচ্ছ প্রশাসন, জনসম্পৃক্ততা এবং মানবিক নেতৃত্বের মাধ্যমে এই দুই কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত-অধিভুক্ত অংশে বর্তমান উন্নয়নধারা বজায় রাখতে হলে রাজনৈতিক সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা জরুরি। আর আজাদ কাশ্মীরে উন্নয়ন তো দূরের কথা—মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনা এখন সর্বাগ্রে প্রয়োজন। সত্যিকারের শান্তি ও উন্নয়ন কেবল তখনই সম্ভব, যখন জনগণ নিজের ভূখণ্ডে ন্যায্য সম্মান ও অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে।